মুসকান এবং রবীন্দ্রনাথ - কেমন লাগলো মুসকান জুবেরির গল্প?
আকাশ সাহা
ছবিঃ- হইচই
“There are two sides to every brain, and there are two sides to every story about the brain.” – Chinyerim Alizor
সময়ের সাথে মানুষের সমস্ত কিছু বদলে যায়, একসময় যে মানুষ পশুর মতো জীবন যাপন করতো তারা হয়ে উঠলো সভ্য কিন্তু মানুষের ভিতরের বুনো স্বভাব তাকে কখনো ছেড়ে যায়নি। অদ্ভুতভাবে আজও আমরা যেনো সভ্য জন্তু।
এই জন্য নেলসন ম্যান্ডেলা বহুবছর আগে বলে গিয়েছিলেন -
"When a man is denied the right to live the life he believes in, he has no choice but to become an outlaw."
সত্যজিৎ রায় তার চলচ্চিত্র নির্মাণ সর্ম্পকে বলে গেছেন - 'সাসপেন্স বা থ্রিলার সিনেমার ক্ষেত্রে যদি প্রথমেই আসল খুনিকে দেখিয়ে দেওয়া হয় এবং পুরো সিনেমা জুড়ে রহস্যের সমাধান তাকে ঘিরেই চলতে থাকে তাহলে দর্শকের কাছে তা আরও আকষর্ণীয় হয়ে ওঠে কিন্তু চলচ্চিত্রের শেষে শুধু ধাক্কা মারলে তা দর্শককে একবারের বেশি কোনোভাবেই মজলিস করবে না। '
সৃজিত মুখার্জির নতুন ওয়েব সিরিজ 'রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো খেতে আসেননি' প্রথম থেকেই পাঠকদের মনে এক প্রত্যাশা জাগিয়ে রেখেছিলো। বাংলাদেশের বিখ্যাত ক্রাইম থ্রিলার নভেলিস্ট মহম্মদ নাজিম উদ্দীনের বিখ্যাত উপন্যাস অবলম্বনে এই সিরিজটি তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু পুরো সিরিজের আসল মজা লুকিয়ে আছে এর প্লট নির্মাণ এবং গল্প বলার ভঙ্গির উপর সেখানে পরিচালক নিজের দক্ষতার পরিচয়ে পুরোপুরি সফল হতে পারেননি।
এই সিরিজটির দর্শককে দুটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে প্রথমত যারা গোটা উপন্যাস পড়েনি এবং যারা উপন্যাস পড়ে সিরিজটি দেখতে বসেছেন। প্রথম ক্যাটাগরির দর্শকের কাছে এই উপন্যাস সত্যিই উপভোগ্য কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেণীর দর্শকের কাছে তা হয়তো হতাশার বিষয়। গোটা সিরিজে অজস্র লুপ হোল বা গ্রাফিক্সের কাজ কোনোটাই তেমনভাবে সাড়া দেয়না বরং অন্যদিকে অভিনয়ে নজর কেড়েছে বেশ কিছু অভিনেতা অভিনেত্রী।
সিরিজের শুরুতে মূল কথক অর্থাৎ নিরুপম চন্দের ভুয়ো সাংবাদিক সেজে রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো খেতে আসেননি রেস্টুরেন্টে যাওয়া সেখানকার খাবার খাওয়া এবং পরে আতর আলীর মাধ্যমে মুসকান জুবেরির সম্পর্কে বিস্তারিত জানা দর্শককে বেশ টানটান উত্তেজনার মধ্যে ধরে রাখে। কে এই মুসকান জুবেরি? কেনো এমন অদ্ভুত এই রেস্টুরেন্টের নাম দিয়েছেন তিনি? রবীন্দ্রনাথের সাথেই বা তার কেমন সম্পর্ক? এমন এক গোপন গায়ে কাঁটা দেওয়া ইতিহাস বেড়িয়ে আসে এই সত্যের আড়ালে যা দর্শককে শিহরিত করে তোলে। কিন্তু এই ইতিহাসের সাথেই উঠে আসে আর এক সত্যি আরও একটি রহস্য যার সমাধানেই মূল ঘটনার সূত্রপাত।
VFX গ্রাফিক্সের কাজ এই সিনেমার একটি প্রধান অংশ। কিন্তু কিছু জায়গায় গ্রাফিক্স ঠিকমতো কাজে না লাগানোয় ফেক বা নকল বলে মনে হয়। তবুও বাংলা সিনেমার বাজেট মাথায় রেখে এই কাজকে কিছুটা হলেও প্রশংসা করতে হয়।
গোটা সিরিজে অভিনয়ের দিক থেকে প্রধান আকর্ষণ মুসকান জুবেরি যে চরিত্রে অভিনয় করেন আজমেরি হক বাঁধন এবং নুরে ছফা যার চরিত্রটিকে পরিচালক নতুন করে সিরিজে নিরুপম চন্দ নামে দেখিয়েছেন। সে চরিত্রে অভিনয় করেছেন রাহুল বোস। দুটি চরিত্র দর্শককে আকর্ষণ করে। বাঁধনের কিছু জায়গায় ওভার একটিং বাদ দিলে গোটা সিরিজেই দুজনে মন কেড়ে নেয় অন্যদিকে আতর আলির চরিত্রে অনির্বাণ ভট্টাচার্য খুবই ভালো তবে অঞ্জন দত্ত অল্প সময়ে এসে দর্শককে আকর্ষিত করে দেয় যদিও ইন্সপেক্টরের ভূমিকায় আর এক অনির্বাণকে কোনোভাবেই সিরিজে মানায় নিই।
সিরিজে মোট নয়টি এপিসোড রয়েছে কিন্তু প্রত্যেকটা এপিসোডে অকারণে রবীন্দ্রসংগীতের ব্যবহার বড়ো কানে লাগে। রবীন্দ্রসংগীতকে ঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারেননি পরিচালক।
যারা এখনো অব্ধি বইটি পড়েননি এবং ভাবছেন সিরিজটি দেখবেন তাদের কাছে শেষের দিকে টুইস্ট ধাক্কা মারলেও সব দর্শকের কাছে সিরিজটি কোনোভাবেই উপভোগ্য নয়। পরিচালক সৃজিত মুখার্জি এর আগে নির্বাক, ২২ শে শ্রাবণ, হেমলক সোসাইটি বা জাতিস্মরে যে কাজ করে গেছেন সেই তুলনায় তার এই নতুন কাজ অনেক বেশি হালকা এবং দুর্বল।
এই চলচ্চিত্রের নির্মাণ প্রসঙ্গে Don Draper একটি বিখ্যাত উক্তি মনে পড়ে যায় -
“Make it simple, but significant..."
Comments