ল্যাটিন আমেরিকার কয়েকটি কবিতার অনুবাদ ও অনুবাদ সংক্রান্ত দু চার কথা:
পর্ব: ১১
তাপস গুপ্ত
অক্তাভিও পাজ (১৯১৪-- ১৯৯৮) বলেছিলেন কবিতা ছাড়া কোন সমাজই হতে পারে না। আর তার অনুবাদিত কবিতার আলোচনা প্রসঙ্গে মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন , অনুবাদ হয়তো অসম্ভবের সাধনা। কারণ কোন অনুবাদ শেষ বা চূড়ান্ত অনুবাদ নয় বারেবারে সংস্কার বা পরিমার্জন সম্ভব। পাজ যখন ভারতে মেক্সিকোর রাষ্ট্রদুতের ( ১৯৬২- ১৯৬৮) কর্ম ও দায়িত্ব পালন করে চলেছেন তখন অতনু রেজ(১৯৪০ - ১৯৯১) তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি তাঁর ' পিয়ের্ড্রা ডে সোল ' কবিতার বইটি উপহার হিসেবে তাঁকে দেন।অতনু বাবু পরে বইটির অনুবাদ করেন এবং নাম দিয়েছিলেন ' আদিত্যশিলা '। আবার এই বইটির অনুবাদ করেছেন অর্পিতা মাইতি মুখোপাধ্যায়। তিনি নাম দিয়েছেন, ' সূর্য প্রস্তর ''।
দক্ষিণ আমেরিকার ক্ষতের নিরাময় সম্ভব হয়ে ওঠেনি। নেশা ও দুর্নীতি মুক্ত সমাজের স্বপ্ন বুকে বার বার বিদ্রোহ বিপ্লব হলেও চোরা অন্তর্ঘাতে সেই স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে বার বার।বিপ্লব আর বিপ্লব ঘিরে সংগ্রামের এই বিফলতা অনেকের মত পাজ বুঝতে পেরেছিলেন। তাঁর "নিঃসঙ্গতার গোলকধাঁধা"(El laberinto de la Soleded) গ্রন্থে তিনি বলছেন,
" মেক্সিকোর বিপ্লব, তার সকল সম্ভাবনা সত্বেও অসফল হয়েছে কারণ বাস্তবিক রূপে ন্যায্য ও মুক্ত সমাজ সৃষ্টি করতে সে অক্ষম (গ্রন্থ ঋণ: মালবিকা ভট্টাচার্য ।"
এই ব্যর্থতা থেকেই লাতিন আমেরিকার মানুষেরা নিজেদের আড়াল করে রাখেন কবিতা সাহিত্যের এবং সৃষ্টির নিঃসঙ্গতায়। পাজ আরও জানাচ্ছেন আমাদের ওই একই গ্রন্থে:
" মেক্সিকোর মানুষ তরুণ অথবা বৃদ্ধ হিস্পানিক বংশের অথবা মিশ্র জাতীয়…যেন দেয়াল দিয়ে ঘিরে রেখেছে নিজেকে বাঁচাবার জন্য। তার মুখ একটা মুখোশ…সে সর্বদাই দূরে থাকে পৃথিবী এবং আর সবকিছু থেকে।…এই দূরত্ব বা নিঃসঙ্গতা আমাদের সংশয় ও আস্থাহীনতা কে মোকাবিলা করার উপায়ের মধ্যে একটা। বোঝা যায় যে আমরা বাইরের জগত কে বিপদজনক মনে করি। আমাদের ইতিহাস এবং যে সমাজ আমরা তৈরি করেছি তারই ফলে মনোবৃত্তি।.. আর কোন জাতি বোধহয় এতটা অসহায় বোধ করেনি, যেমন অ্যাজটেক জাতি বোধ করেছিল,... ওদের সঙ্গে আগ্রাসী স্পেনের সম্পর্ককে অ্যাজটেক জাতির আত্মহনন ছাড়া কিছু বলা চলে না।" এই বোধের বিস্তার থেকেই মনে হয় নিকারাগুয়ান কবি ক্লারিবেল আলিগ্রিয়া শিকড়ের গভীরে অস্তিত্ব সন্ধানের কথা বলেছেন বারবার (তার সাক্ষাৎকারটি গত পর্বে প্রকাশিত)।
কালচার এন্ড আইডেন্টিটি প্রবন্ধে john ch. brown এই আইডেন্টিটি র বেশ কিছু ধরণের কথা আমাদের জানাচ্ছেন: পার্সোনাল আইডেন্টিটি, সেল্ফ আইডেন্টিটি, কালচারাল আইডেন্টিটি, সোসিও পলিটিক্যালএবং সিম্বলিক আইডেন্টিটি। তবে ঐতিহ্যের প্রতি অতিরিক্ত বিস্তার তাকে আঁকড়ে ধরার সার্বিক প্রচেষ্টা কবি এবং তাকে ঘিরে থাকা পারিপার্শ্বিক সমাজকে কিছুটা হলেও মৌলবাদ - কলুষিত করে তোলে। এই অভিজ্ঞতার কথা কবি সিমাস হিনি তার ইংল্যান্ড অফ দা মাইন্ড গ্রন্থে কিছুটা বিস্তারিত ভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন। ১৯৮৫ সালে ডেভিড লয়েডের সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারের অংশেই সিমাস হিনি এই অনুভূতিকে অকপট ভাষায় তুলে ধরেছিলেন। তারি কিছু অংশ এখানে তুলে ধরলাম:
" কবি হিসেবে যাঁরা ইংল্যান্ডের মূল অধিবাসী নন কিন্তু ইংল্যান্ডে থেকেই ইংরেজি ভাষায় কবিতা লেখেন তাঁরা ঐতিহ্য ইতিহাস ও পরম্পরা বহনকারী কবি মণ্ডলীর দ্বারা পীড়িত হয়ে থাকেন(afflicted)। ধারাবাহিক ভাবে সেই ঐতিহ্য অতীত কে সংরক্ষণ ও সরবরাহ করার সাম্প্রদায়িক উপলব্ধিগত তাগিদ অনেক সময় হুমকির ভাষা হয়ে ওঠে(which is threatened all this is signified in their language)।"
হিনি বলতে চাইছেন এই পরিস্থিতি কবির কাছে
এক নির্বাসিত দ্বীপের মত হয়ে ওঠে। অর্থাৎ কোনো কোনো সময় লাতিন আমেরিকায় এই ভাবনা তাকে কবি হিসেবে একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির গোঁড়ামিতে বেঁধে ফেলে। এখানে অতি প্রাসঙ্গিক ভাবেই উল্লেখযোগ্য কবি জোসে কোজার ( জন্ম১৯৪০) এর ২০১৫ সালে একটিডকুমেন্টারি ভিডিও সাক্ষাৎকারের অংশ বিশেষ। হাভানায় জন্ম নেওয়া কবি জোসে কোজার পোলিশ বাবা এবং চেক মায়ের সন্তান। বাবা কুইন্সকলেজে (নিউইয়র্ক)পড়াতেন স্প্যানিশ ভাষা এবং ল্যাটিন আমেরিকান সাহিত্য। ভিডিও টির টাইটেল ছিল " মি জাপানীজ"। ক্রিসমাসে চলাকালীন তাঁর একটি বাচ্চার সঙ্গে (অনুবাদিত) কথোপকথন:
বাচ্চা:তুমি যীশুকে মেরেছ কেন?
জোসে কোজার: আমি তাঁকে মারিনি,কাউকেই মারিনি,তুমি এসব কি বলছ?
বাচ্চা: তুমি কি কিউবান, পোলিশ, নাকি ইহুদি?
জোসে: একই সঙ্গে সব।
এই ডকুমেন্টারি ভিডিও টির শুরুতেই যে কবিতা আছে তাতে সেই কবিতাটি এই রকম:
সত্বা একটি বন্দী শালা
সত্বা বা অস্তিত্ব কী তোমার ?
আমি বলি এটি হল আমার
জীবনের রূপকথা গল্প
আমি কিউবান হলেও যদি কেউ বলেন
তুমি কি আর্জেন্টিনীয়?
আর্জেন্টিনীয় হলে যদি কেউ বলে
তুমি কি ক্যারিবিয়ান দ্বীপ থেকে এলে?
আমি পর্তুগিজ ভাষার কথা বললে
প্রশ্ন ওঠে তুমি কি ব্রাজিলিয়ান?
এখান থেকে উত্তরের বিন্দু ছুঁয়ে বলে উঠি
" মি জাপানীজ,মি জাপানীজ"।
বলার এই যে,নিজের অতীত ঐতিহ্য কে আঁকড়ে ধরার নামে এই সাম্প্রদায়িক উগ্র মনোভাব বিশ্ব জনীন বিশ্বমানব হয়ে ওঠার পথে প্রবল বাধাস্বরূপ কেবল নয়, মনুষ্যত্বের ধারণাটিতেও অবমাননাকর।অচলায়তন ভেঙে রূপ থেকে অরূপে আর সীমা থেকে অসীমে যাবার শিক্ষা ভাগ্যিস রবীন্দ্রনাথ নামের মানুষটি বারে বারে দিয়ে যেতে চেয়েছেন সেই উত্তরাধিকার আমাদের।
Comments