শিবে তান্ত্রিক আর জমিদার বাড়ির মন্ত্রবাঁধন
অন্বেষা বর্মন
ট্রেন থেকে নামতে বেশ বেলা হয়ে গেল সৌম্যর। অনেকদিন পর সে তার গ্রামের বাড়িতে আসছে। সঙ্গে আসছে সৌম্যর দুই বন্ধু, প্রীতম আর সায়ন। দুজনে হাতে হাতে লাগেজগুলো ট্রেন থেকে নামিয়ে রাখছিল। এমনিতেই ট্রেনটা লেট করেছে, তাই সৌম্য একটু যেন বিরক্তই ছিলো। এতক্ষণ ট্রেনে বসে থেকে প্রীতমেরও মাথা ধরে গেছে। সায়ন অবশ্য ট্রেনে আসার সময় দুই পাশের সবুজ ধান ক্ষেত, গ্রাম্য দৃশ্য বেশ উপভোগ করছিলো। সায়ন ছোটো থেকে কলকাতাতেই থেকেছে। গ্রাম্য পরিবেশ তার বেশ ভালো লাগছে তাই।
সৌম্য, প্রীতম আর সায়ন তিন বন্ধু। কলেজের সময় থেকে ওদের বন্ধুত্ব। এখন ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর তিন বন্ধুই চাকরি করে। প্রীতম আর সায়ন পুণেতে থাকে। দিওয়ালির ছুটিতে তারা কলকাতায় এসেছে। আর সৌম্য কলকাতায় একটা নামী এমএনসি তে চাকরি করে। ছোটবেলায় সৌম্যর বাবা মা একটি পথ দুর্ঘটনায় মারা যান। তারপর থেকে সৌম্য তার দাদু দিদার কাছেই মানুষ হয়েছে। এই গ্রামের পৈতৃক বাড়িটিতে কালীপুজোয় আসার প্ল্যান তৈরি করেছিল সৌম্যই। তাই অনেকদিন পর দুই বন্ধুকে নিয়ে সৌম্য চলে এসেছে তার গ্রামের বাড়িতে। এখন এই বাড়িটিতে কেয়ারটেকার বিপিন কাকা থাকে। সৌম্য আগেই বিপিন কাকাকে খবর দিয়েছে যে তারা আজ আসছে। তাই যেন দুটো ঘর পরিষ্কার করে রাখা হয়।
স্টেশন থেকে বেরোতেই একটা বছর বাইশের ছেলে তাদের দিকে এগিয়ে এলো। ছেলেটি বললো, " আপনি কি সৌম্য দা? " সৌম্য বললো, " হ্যাঁ, তোমাকে তো ঠিক চিনলাম না ভাই।" ছেলেটি বলল, " আমাকে বাবা পাঠিয়েছে, আপনাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য।" সৌম্য জিজ্ঞেস করলো, " তুমি কি বিপিন কাকার ছেলে পরেশ?" ছেলেটি হালকা হেসে বললো, " হ্যাঁ, চলুন। ওখানে টোটো রাখা আছে। অনেকটা রাস্তা তো, এখানে গ্রামে এই টোটো ছাড়া সেরকম কিছু পাবেন না। তাই বাবা আমাকে বললো টোটোটা নিয়ে যেতে। আমি তো এই গ্রামেই টোটো চালাই।" সৌম্য হেসে বললো, " ঠিক আছে, তবে যাওয়া যাক।"
টোটো করে আসতেও প্রায় মিনিট পঁচিশ লাগলো ওদের। বেশ পুরনো হলেও বাড়িটা বিশাল বড়। সামনে অনেকটা বড়ো জায়গা। তার মাঝখানে একটা পুরোনো ফোয়ারা আছে। যদিও সেটা এখন চলে না। বাড়ির পাশে অনেক বড় বড় বাগান। আর পূর্ব দিকের কোণে একটা বিশাল বড় দীঘি। খুব সুন্দর করে এখনো বাঁধানো ঘাট আছে। প্রীতম আর সায়ন মুগ্ধ হয়ে আশেপাশের দৃশ্য দেখছিলো। কি সুন্দর ঠাণ্ডা ঠান্ডা আবহাওয়া। এই গরম দুপুরেও প্রাণটা যেন জুড়িয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ বিপিন এসে বললো, " বাবু, আপনারা এসে গেছেন!আসুন, আপনাদের ব্যাগ গুলো দিন।" পরেশকে উদ্দেশ্য করে বলল, " যা বাবা, ব্যাগপত্রগুলো ওনাদের ঘরে রেখে দিয়ে আয় বাবা।" তারপর সৌম্যদের উদ্দেশ্য করে বলল, তা বাবু, আপনারা হাত মুখ ধুয়ে নিন, একেবারে দুপুরের খাবার খেয়ে নেবেন? নাকি একটু কিছু মুখে দিয়ে তারপর দুপুরের খাবার খাবেন? " সৌম্য, প্রীতম আর সায়ন তিনজনেই স্নান করে একেবারে দুপুরের খাবার খাবে ঠিক করলো।
ঘরে এসে প্রীতম সৌম্যকে বললো, " ভাই, দীপাবলি এবারে ভালোই কাটবে মনে হচ্ছে।" সায়ন আর প্রীতম একই ঘরে থাকবে। ওরা দুজন অনেক রাত অব্দি তাস খেলে। কিন্তু সৌম্যর একটু তাড়াতাড়ি ঘুমোনোর অভ্যেস আছে। তাই সে অন্য ঘরে থাকবে। পাশাপাশি দুটো ঘর। আর ঘরের পাশে ওদের বাথরুম। যাই হোক, তিন বন্ধু স্নান সেরে খেতে গেল। সকাল থেকে জার্নি করে অসম্ভব খিদে পেয়েছে তাদের। দুপুরে ভাত, আলু পোস্ত, আর পুকুরের কাতলা মাছের ঝোল দিয়ে খাওয়া দাওয়াটা বেশ ভালোই হলো। ঘরে এসে প্রীতম বললো, "যাই বল, বিপিন কাকা রান্নাটা কিন্তু সেরা করে।" একটা সিগারেট ধরিয়ে সায়ন বললো, " আপাতত একটু গড়িয়ে নিই, বিকেলে চারপাশটা বেশ ঘুরে ঘুরে দেখবো।" সায়ন বললো, " আচ্ছা, ঐদিকের ওই পুকুরটায় কেউ যায় না? যেটা তোদের বাড়ির দক্ষিণ কোণের দিকে আছে। " সৌম্য বললো, " নারে, ওই পুকুরটাতে কেউ যায় না। বহুদিন সংস্কার করা হয়নি।" সায়ন আর কিছু বলল না।
বিকেলে তিন বন্ধু বেড়াতে যাবে, এমন সময় বিপিন এসে ওদের বলে, " বাবু, আপনারা কোথায় যাচ্ছেন?" সৌম্য বলে, "এই একটু আশেপাশে ঘুরবো।" বিপিন বলে," ঠিক আছে বাবু, কিন্তু বেশি রাত করবেন না। কোথায় পাশের জঙ্গল থেকে শিয়াল বেরিয়ে আসে, তার ঠিক নেই। গ্রামের দিকের মানুষ রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমোয় কিনা।" সৌম্য হেসে বললো, " আচ্ছা বিপিন কাকা,তোমার চিন্তা নেই। চলে আসবো।"
ওরা তিনজন গ্রামটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো। বেশ সুন্দর, গ্রাম্য পরিবেশে ওদের বেশ ভালো লাগছিলো। সায়ন হঠাৎ সৌম্যকে ডেকে বললো, "আচ্ছা, ওই যে তোদের বাড়ি থেকে একটু পেছনে ভাঙাচোরা বাড়ির ধ্বংসাবশেষটা পড়ে আছে, ওটাতে কি তোরা থাকতিস?" সৌম্য উত্তরে বললো, "হ্যাঁ,অনেক কাল আগে আমার কোন এক পূর্বপুরুষ ওই বাড়ি ছেড়ে চলে আসেন। তারপর থেকে ওখানে কেউ থাকেন না। কি সমস্যা হয়েছিল, জানিনা।কিন্তু মা আমাকে ওখানে ছোটবেলায় যেতে বারণ করতো।" প্রীতম বললো,"চল তাহলে, একবার গিয়ে দেখি।" তিন বন্ধু ওই ভাঙাচোরা, জরাজীর্ণ বাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ভেতরে দেওয়াল কোথাও ভেঙে পড়েছে, চারিদিকে বন জঙ্গল, কেমন গা ছমছমে পরিবেশ। প্রীতম একটু অস্বস্তি নিয়ে বললো, "ছেড়ে দে, আজ আর যাবো না। ভেতরে কোনো পোকামাকড় অথবা বিষাক্ত সাপ যদি থাকে! পরে আসা যাবে।" কিন্তু সৌম্য সেকথায় কান দিলো না। কেমন যেনো মোহগ্রস্তের মতন ওই বাড়িটার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। সায়নও বেশ সাহসী। সৌম্যর পেছন পেছন এগিয়ে যেতে থাকলো। বাড়ির ভেতরটা আগাছায় ভরে গেছে। অনেকদিন আগের করা দেওয়ালের চুন সুরকি অনেক আগেই খসে গেছে। অনেকক্ষণ বাড়ির এদিক ওদিক ঘোরাঘুরির পর প্রীতম বেশ রেগে গিয়ে বললো, "তোরা কি যাবি? নাকি আমি একাই চলে যাবো?" সায়ন দেখলো সন্ধ্যে হয়ে আসছে। এইসময় না ফিরলে বিপিন কাকা চিন্তা করবেন। তাই সৌম্যকে নিয়ে একরকম টানতে টানতে ওরা বাড়ি ফিরে চললো। বাড়িতে ফিরতেই বিপিন কাকা ওদের জন্য চা আর সিঙ্গাড়া দিয়ে গেল। সায়ন লক্ষ্য করছে, ওই বাড়ি থেকে ফেরার পর থেকে সৌম্য কেমন গম্ভীর হয়ে আছে। সায়ন ওকে জিজ্ঞেস করতে সৌম্য বললো, " কিছু না, এমনি শরীরটা খারাপ একটু। সেরকম কিছু হয়নি।" যাইহোক, তিন বন্ধু একসাথে গল্প করতে করতে রাত হয়ে গেলো। রাতে সৌম্য ঠিক করে খেলো না। সায়ন আর প্রীতম ভাবলো ওর হয়তো শরীরটা ভালো নেই। তাই কিছু না বলে ওরা শুতে চলে গেলো। সৌম্য পাশের ঘরে একা ঘুমোবে।ও একটু তাড়াতাড়ি ঘুমোয়। প্রীতম আর সায়ন অনেক রাত অব্দি তাস খেলবে, এরকমই ঠিক করে রেখেছে। কিন্তু রাত বারোটা নাগাদ হঠাৎ শুনতে পেল বাইরে বিপিন কাকা খুব জোরে জোরে তাদের ডাকছে। ওরা দুজন বাইরে বেরোতে বিপিন কাকা ওদের বললো,"রাত্রে বারান্দার আলো নেভাতে গিয়ে উনি দেখেছেন সৌম্য তার ঘরে নেই। উনি ভেবেছিলেন হয়তো বাড়ির কোথাও আছে। কিন্তু কোথাও না দেখতে পেয়ে বিপিন কাকা আর তার ছেলে পরেশ দুজনে খুঁজতে খুঁজতে তাকে পুকুরের ধারে অজ্ঞান অবস্থায় দেখতে পায়। তারপর কোনরকমে তাকে বাড়িতে নিয়ে আসে। গ্রামে ডাক্তারকে খবর দেওয়া হয়েছে, উনি এসে ওষুধ দিয়ে গেলেন সৌম্যকে। পরেরদিন সকালে সৌম্যর জ্ঞান ফিরতে ওকে বিপিন জিজ্ঞাসা করলো,"বাবু,কাল রাত্রে আপনি বাইরে কেন গেছিলেন?" সৌম্য বললো, একটা বাচ্চা মেয়ে তাকে ডাকছিলো। রাতে ঘুম না আসায় ও বারান্দায় পায়চারি করছিলো। হঠাৎ পুকুরের ধারে একটা মেয়ে তাকে ডাকে, বলে তার মা নাকি পুকুরে ডুবে যাচ্ছে, বাঁচাতে হবে। বিপিন কাকা গম্ভীরভাবে তাকে জিজ্ঞাসা করলো, "তারপরে কি হলো?" সৌম্য বলে, তারপর আর কিছু মনে নেই ওর। বিপিন কাকা আবার গম্ভীর হয়ে সৌম্যকে বলে," যাইহোক বাবু, আপনি রাতে আর ঘর থেকে বেরোবেন না। এই জমিদারবাড়ির রক্ত তো আপনার শরীরেও আছে।" এমন একটা কথা শুনে সায়ন বললো," জমিদার বাড়ির সাথে ওর অজ্ঞান হবার কোন যোগ আছে কি? কিরকম কথা বলছেন আপনি? হয়তো ঠিক করে ঘুম হয়নি তাই হ্যালুসিনেট করেছে বা ভুল কিছু দেখেছে।" বিপিন কাকা আর কোনো কথা না বলে ওখান থেকে চলে গেল। পরদিন দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর প্রীতম আর সায়ন লক্ষ্য করলো সৌম্য কেমন যেন ছটপট করছে। ওর চেহারা একদিনের মধ্যে কেমন যেন শুকিয়ে গেছে। যাইহোক, সৌম্যকে ওরা ওষুধ খাইয়ে নিজেদের ঘরে চলে গেল। সেইসময়ে বিপিন কাকা ওদের ঘরের সামনে এসে বললো, " বাবারা, একটু ভেতরে আসতে পারি? " ওরা বিপিনকাকাকে ভেতরে এসে বসতে বললো। বিপিন আসতে আসতে বললো,"আপনারা শহরের লেখাপড়া জানা ছেলে, ভূত প্রেত বিশ্বাস করেন না। কিন্তু এই জমিদার বাড়ির ওপর এক অভিশাপ আছে। সেইজন্য আজকে সৌম্য দাদাবাবুকে একটু সামলে রাখবেন।"
এদিকে কালকের ঘটনার পরই পরেশ তার বাবাকে বললো,"বাবা, আমাদের মনে হয় আর দেরি করা ঠিক হবে না। কালীবাড়ির তান্ত্রিককে ডেকে নিয়ে আসি। বলা যায় না, আজ ভূত চতুর্দশীর রাত। কোনো অঘটন ঘটে গেলে সৌম্য দাদাবাবুর বয়স্ক দাদু দিদাকে আমরা কোনো উত্তর দিতে পারবো না।" বিপিন বললো,"হ্যাঁ বাবা, তুই বরং যা, তান্ত্রিক মশাইকে ডেকে নিয়ে আয়। এই পাপের বোঝা আর কতদিন বয়ে বেড়াতে হবে ওদের, কে জানে!"
এদিকে সন্ধ্যের পর সৌম্যর অবস্থা এতই খারাপ হয় যে আবার গ্রামের ডাক্তারকে ডাকতে হয়। ওর রক্তবমি হয়েছে কয়েকবার আর হাত পাগুলো কেমন যেন বেঁকে বেঁকে যাচ্ছে। প্রীতম আর সায়ন কোনরকমে নিজেদের বন্ধুকে সামলাচ্ছে। বিপিন বাইরে কিসের জন্য যেন বারবার তাকাচ্ছে পরেশ কখন ফিরবে, সেটাই মনে মনে ভাবছেন হয়তো। ঠিক তখনই পরেশ ফিরে এলো। বিপিন বাবু জিজ্ঞেস করলেন," তান্ত্রিক মশাই এলেন না?" পরেশ বললো,"উনি সৌম্য দাদাবাবুর মঙ্গল কামনায় এক বিশেষ যজ্ঞ করবেন। আর এই তাবিজটা ওনাকে পরিয়ে দিতে বলেছেন।" প্রীতম আর সায়ন কি করবে বুঝতে পারছিল না। ডাক্তারবাবু কিছু বললেন না। পরেশ গিয়ে সৌম্যর হাতে তাবিজটা বেঁধে দিল। রাত যত বাড়তে লাগলো,সৌম্যর শরীর ততই খারাপ হতে লাগলো। ঠিক যখন রাত এগারোটা হবে, তখন হঠাৎ সৌম্য সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালো। কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা বাড়ির সেই দক্ষিণ দিকের কোণ বরাবর পুকুরের দিকে যেতে লাগলো। প্রীতম আর সায়ন সৌম্যকে আটকানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু কি অসম্ভব অমানুষিক শক্তি সেইসময় ওর গায়ে, ওদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ও ওই পুকুরের দিকে যেতে লাগলো। সৌম্য যেন কোন এক মোহের বশে সেই পুকুর পেরিয়ে ওদের ভাঙ্গা জমিদারবাড়ির ধ্বংসাবশেষের দিকে এগোতে থাকলো। হঠাৎ করে মনে হলো কোন এক অদৃশ্য দড়ি সৌম্যর গলায় কেউ পেঁচিয়ে দিয়ে ওকে হত্যার চেষ্টা করছে। হঠাৎ করেই সৌম্য জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলো, কিন্তু মাটিতে পড়লো না। তার আগেই তাকে ধরে ফেললো দুটো বলিষ্ঠ হাত। সৌম্য দর্শন এক যুবক, গালের চোয়াল শক্ত, টিকালো নাক আর গৌরবর্ণ। বিপিন দৌড়ে গেলো, প্রণাম করে বলল, " ঠাকুর মশাই! আপনি এসে গেছেন! আপনি না থাকলে আজ দাদাবাবুকে কে বাঁচাতে আসতো?" প্রীতম আর সায়ন ততক্ষণে এগিয়ে এসেছে। ওরা বিপিন কাকাকে জিজ্ঞেস করলো, "ওনাকে তো ঠিক চিনলাম না।" বিপিন বললো," উনি হলেন শিবে তান্ত্রিক, শিবেশ্বর বন্দোপাধ্যায়।"
যাইহোক, কোনরকমে সৌম্যকে ধরে তার ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। শিবেশ্বর ঘরের চারপাশে কি একটা মন্ত্র পড়ে গণ্ডি কেটে দিলেন। তারপর ওদের বললেন,"তোমরা নজরে রেখো, এই গণ্ডির বাইরে উনি যেনো বেরোতে না পারেন।" এবার বিপিনের দিকে তাকিয়ে বললেন," বিপিন, তুমি যেটা জানো, সেটা ওর বন্ধুদেরও বলো।" একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বিপিন শুরু করলো," আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগের কথা। তখন এই রায় পরিবারের জমিদার অলক নারায়ন রায় খুব অত্যাচারী ছিলেন। প্রজাদের ওপর খুব জুলুম করতেন। গ্রামের মেয়েরা তাঁর ভয়ে তটস্থ থাকতো, ঘর থেকে বেরোতেও তারা ভয় পেত। আমার ঠাকুরদার বাবা তখন এই বাড়িতে নায়েবের কাজ করতেন। এই গ্রামেই একদিকে রমাবালা তার একমাত্র মেয়েকে নিয়ে থাকতো। অল্প বয়সে বিধবা হয়ে তার স্বামীর যেটুকু ছিলো, তাই দিয়ে মা মেয়ের পেট কোনরকমে চলে যেত। এইভাবেই একদিন অলক নারায়নের চোখ পড়লো রমাবালার ওপর। রমাবলার সাতকুলে কেউ নেই। তাই তার ওপর নিজের জোর খাটাতে বেশি সময় লাগেনি অলক নারায়নের। এইভাবে অনেক রাত রমাবালার ওপর অকথ্য অত্যাচারের পর একদিন ওই নরপিশাচের চোখ যায় রমার একমাত্র ফুটফুটে মেয়ে বিন্দুবাসিনীর ওপর। বিন্দুবাসিনীর বয়স তখন সবে বছর দশেক হবে। কিন্তু গ্রামের লোকেরা রমাবালার ঘটনা সবই জানতো। তাই তার মেয়ের বিয়ে হচ্ছিলো না। এরকমই এক রাতে জমিদারের পেয়াদারা বিন্দুবাসিনীকে জমিদারবাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। সেই রাতের অকথ্য অত্যাচারে বিন্দুবাসিনী সেখানেই প্রাণ হারায়। মেয়ের এই অকাল মৃত্যু সহ্য করতে না পেরে রমাবালা এই পুকুরে ডুবে আত্মহত্যা করে। সে মৃত্যুর আগে জমিদারকে বলে যায়, এই পরিবারের কোন পুরুষকে সে বাঁচতে দেবে না। এই বংশ,নির্বংশ না হওয়া পর্যন্ত তার মুক্তি হবে না। জমিদার এই কথায় কান দেয়নি। কিন্তু কিছুদিন পরেই জমিদারকে তার ঘরে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। সেই মৃত্যুর রহস্য কেউ জানতে পারেনি। সেই ঘটনার এক বছর যেতে না যেতেই অলক নারায়নের বড়ো ছেলেও একইরকম ভাবে মারা যায়। মনে হয়, কেউ যেন গলা টিপে তাকে হত্যা করেছে। এই ঘটনার পর অলক নারায়নের ছোটো ছেলে তাদের পুরোনো বাড়ি আর পুকুর এক তান্ত্রিক ডেকে পুজো করে বাঁধন দিয়ে এই নতুন বাড়িতে আসেন। তারপর অনেকদিন কোনো সমস্যা হয়নি। এতদিন পর কেন হলো, বুঝতে পারছি না।" এতক্ষণ প্রীতম আর সায়ন মন দিয়ে সব শুনছিল। এই যুগে দাঁড়িয়ে এসব বিশ্বাস করতেও বেশ অবাক লাগলো তাদের। কিন্তু তারা যা দেখেছে, তা বিশ্বাস না করে উপায় নেই। শিবেশ্বর এবার বললেন,"আপনারা কি ওই পুরোনো বাড়িটিতে গেছিলেন?" প্রীতম বললো, " ওই বাড়িতে আমরা গিয়েছিলাম। তার জন্য এমন হবে, ভাবতে পারিনি।" শিবেশ্বর বললেন, " ওই বাড়িতে কোন পুরুষ গেলেই ওই মন্ত্র বাঁধন ভেঙে যাবে। তখন শুরু হবে এই অভিশাপের খেলা।" বিপিন হাতজোড় করে বললো, " ঠাকুর মশাই, এবার কি হবে? কি করে বাঁচাবো আমরা সৌম্য দাদাবাবুকে?" শিবেশ্বর বললেন," আজ রাতে মন্ত্র বাঁধন আবার আমি করে দেবো। কিন্তু দেখো, কোনোভাবেই যেন তোমার দাদাবাবু ওই গণ্ডির বাইরে না বেরোয়। যত রকমের আওয়াজ হোক,আমিও যদি ডাকি, তবুও যেন না বেরোয়।" বিপিন বললো, " বেশ, তাই হবে ঠাকুর মশাই।" শিবে তান্ত্রিক আর কিছু না বলে ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে অন্ধকারে মিশে গেল। তারপর ওই পুরোনো বাড়িতে গিয়ে সে শুরু করলো মহাযজ্ঞ। আর এইদিকে সৌম্য প্রচন্ড ছটফট করতে লাগলো। তাকে কোনরকমে খাটের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। বাইরে যেন কেনো নারী কন্ঠ ভয়ঙ্কর ভাবে হেসে চলেছে। মনে হচ্ছে কোনো দানব বাইরে উদ্দাম নৃত্য করছে। ওইদিকে শিবে তান্ত্রিক মন্ত্র পড়ে রমাবালা আর বিন্দুবাসিনীর আত্মাকে ডাকছে। তারা সামনে আসতেই শিবে বললো, " আমি জানি তোমাদের সাথে অন্যায় হয়েছে। কিন্তু এই অভিশাপের জালে আর কতদিন আটকে থাকবে? আমি তোমাদের মুক্তি দেবো। কিন্তু এই অভিশাপের জন্য আর কোনো নিরপরাধ মানুষকে তোমরা মারতে পারবে না।" এই বলে সে মন্ত্রচ্চারণ করে তাদের আত্মাকে একটা মাটির ভাঁড়ে বন্দি করে নিল। বাইরের ঝড় হঠাৎ শান্ত হয়ে গেল। পরেরদিন সকালে সৌম্য অনেকটা শান্ত এবং সুস্থ হয়ে উঠেছে। তার আগের রাতের ঘটনা কিছুই মনে নেই। শিবে তান্ত্রিক তার হাতে একটি কবচ বেঁধে দিল। বললো সেটি কখনো না খুলতে। প্রীতম আর সায়ন বাইরের বাগানে এসে দাঁড়িয়েছে। আজকের আকাশ যেন অনেক নির্মল। জমিদার বাড়ির দেওয়ালে কোনায় কোনায় যে কি রহস্য লুকিয়ে আছে, সেটাই তারা ভাবছিল। হঠাৎ শিবেশ্বরকে বাইরে যেতে দেখে এগিয়ে এসে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো। শিবেশ্বর মৃদু হেসে তাদের আশীর্বাদ করে গ্রামের রাস্তা ধরে তাঁর নতুন গন্তব্যের দিকে এগোতে লাগলো। তার কিছুদিন পর তিন বন্ধু কলকাতায় ফিরে আসে। এখন তারা সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত। ওই গ্রামের বাড়ি যাবার ইচ্ছে তাদের আর কখনো হয়নি।
Comments