top of page
Search
agantukpotrika

শ্যামাপূজা সংখ্যা ।। ধারাবাহিক ( অজয়পাড়ের উপকথা ) ।। সুদীপ ঘোষাল


অজয়পাড়ের উপকথা

সুদীপ ঘোষাল

সপ্তম পর্ব



পটুয়াপাড়া গ্রামের একজন শিক্ষিত লোকের সঙ্গে পরিচয় হল। তিনি বললেন, যশোর ও খুলনা অঞ্চলে পটুয়াদের গাইন’ নামে অভিহিত করা হয়। অবিভক্ত বাংলায় ঢাকা, ময়মনসিংহ, নোয়াখালী, সিলেট, ফরিদপুর, যশোর, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী এবং দিনাজপুর অঞ্চলে পটুয়ারা বসবাস করত। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পটভুমিতে দেশবিভাগের পর অধিকাংশই পশ্চিমবঙ্গে চলে যায়। যারা থেকে যায় তাদের পেশায়ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ভাটা পড়ে। বর্তমানে নরসিংদী, মুন্সিগঞ্জ, খুলনা, যশোর ও জামালপুর অঞ্চলে কদাচিৎ দুএকজন পটুয়া বা গাইন শ্রেণীর শিল্পীর সাক্ষাৎ মেলে। পটুয়ারা বিভিন্ন মেলা, ধর্মীয় উৎসব-অনুষ্ঠান এবং গ্রামে-গঞ্জে পটচিত্র বিক্রয় করে। হিন্দুদের মধ্যে অনেকে বিভিন্ন দেবদেবীর পট পূজা-অর্চনার জন্য সংরক্ষণ করে।পটুয়াদের একটি বড় অংশ বেদে সম্প্রদায়ভুক্ত। তাদের বিবাহাদি সামাজিক অনুষ্ঠান হিন্দু-মুসলিমরা একসাথে পালন করে। তাদের সামাজিক জীবনযাপন একইরকম।তিনি আরও বললেন, পটুয়া শব্দের আক্ষরিক অর্থ যারা "পট" (ছবি) আঁকে। পট অঙ্কন গ্রামবাংলার প্রাচীন লোকশিল্প। এর কিছু নিদর্শন এখনো বেঁচে আছে । যামিনী রায় প্রাশ্চাত্যের অঙ্কনরীতিতে পারঙ্গম হলেও পটশিল্পকে নিজের অভিব্যক্তির মাধ্যম হিসাবে তুলে নিয়ে পটশিল্পকে প্রাশ্চাত্যের কাছে বিখ্যাত করেন। কিন্তু যামিনী রায় পটুয়া নন। পটুয়ারা একটি পেশাভিত্তিক লোকগোষ্ঠী যাদের প্রধান পেশা বংশানুক্রমে নিজেদের বিশেষ রীতিতে পট অঙ্কন ও প্রদর্শন বা বিক্রয় করা।



আমরা ছোটবেলায় দেখতাম বীরবাহাদুর কাকু একটা গোটানো দলিলের মত পটচিত্র বগলে বাড়ি বাড়ি ঘুরতেন। একটা বাড়িতে সুর করে তিনি রামায়ণের কাহিনী বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে ছবি দেখাতেন গোল গোটানো বান্ডিল থেকে। নানরকম ছবি তাতে আঁকা।রাবণ ভিখারী সেজে সীতাকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছেন লঙ্কায়। দুটো ঘোড়া সহযোগে পুষ্পকরথের ছবি। জটায়ু বাধা দিচ্ছে আর রাবণ তাকে তরবারি সহযোগে আঘাত করছেন। জটায়ুর ডানা কাটা দেখে আমার কান্না আসত। কখনও সখনও মা মাসিরাও কেঁদে ফেলতেন কাকুর করুণ সুরের আবেগে। বীরবাহাদুরের পটকাহিনীর বিষয়গুলো ছিল, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক, ধমীয়, সামাজিকএবং পরিবেশগত। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে বিষয়নিরপেক্ষ পটগুলির মধ্যে যে কোনও ধরনের নর ও নারীর ছবি অথবা শিল্পচিত্র দেখা যায় এবং সামাজিক পট বলতে বোঝায় সামজিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য যে পটচিত্র গুলি অঙ্কণ করা হ্য় সেইগুলি। যেমন পোলিও টীকাকরণ অভিযান, ম্যালেরিয়া দূরীকরণ, সাম্প্রদায়িক সম্পৃতী, বৃক্ষরোপন, এইডস সন্মন্ধীয় সচেতনতা বৃদ্ধি, মানবাধীকার ও নারীনিগ্রহ বিরোধী সচেতনতা বৃদ্ধি সঙ্ক্রান্ত পটচিত্রগুলি। আমাদের গ্রামে চলতি সমস্যাগুলেো নিয়েও বীরবাহাদুর পট আঁকত।

আমি বীরবাহাদুরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, পট কি গো?

বীরবাহাদুর বললো,পট মানে কাপড় গো। ন্যাকড়া যাকে বলো।

আমি বললাম, কি কি বিষয়ের উপর তোমার পট আঁকা আছে কাকু?

বীরবাহাদুর কাকু বললো,পৌরাণিক বিভিন্ন গল্প ও গাথা এই পটের উপজীব্য। সেগুলি হল রাবন বধ, সিতা হরণ, রাজা হরিশ্চন্দ্র, কৃষ্ণলীলা, দুর্গালীলা, সাবিত্রী-সত্যবান, মনসা মঙ্গল, চন্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, আনন্দ মঙ্গল, কালকেতু ফুল্লরা ইত্যাদি।ঐতিহাসিক পটের উপজীব্য যা এর নাম থেকেই প্রকাশিত তা হল ঐতিহাসিক ঘটনাবলী। যেমন- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, আজাদ্ হিন্দ্ বাহিনী ও নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, আণবিক বোমাবর্ষণ

আমি বললাম, আঁকার পদ্ধতি কি রকম?



কাকু বললেন, কাপড়ের জমিন তৈরির পর অঙ্কনকাজ শুরু হয়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশজ রঙের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য; যেমন: ইটের গুঁড়া, কাজল, লাল সিঁদুর, সাদা খড়ি, আলতা, কাঠ-কয়লা ইত্যাদি। পটটিকে কয়েকটি অংশে ভাগ করে কাজ করা হয় এবং রংয়ের প্রকারের মধ্যে লাল, নীল, হলুদ, গোলাপী, বাদামী, সাদা এবং কালো ব্যবহৃত হয়। মাটির হাঁড়ি উপুর করে কেরোসিন লম্ফের উপর ধরা হয়। কালো মোটা স্তর চেঁচে কালি করা হয়।

পট দেখানোর পরে পটুয়া বীরবাহাদুর বাড়ি গিয়ে ঝোলা নামিয়ে বসেন। তিনি গিন্নিকে ডেকে বলেন, কই গো রাজুর মা এক গেলাস জল দাও কেনে। রাজুর মা বলে, আজ কতদূর যেয়েছিলে। পটুয়া বলেন, আজ ভাতারের পাশে শুষনা গেরামে গেয়েছিলাম গো। বড্ড খাটুনি হল।

বীর বলেন, গিন্নি একটা গামছা দিয়ে পিঠ মুছিয়ে দাও না ক্যানে।

গিন্নি একটু পরে গামছা এনে ঘাম মুছে দেন আদরে।

বীরবাহাদুর কাকুর ছেলে রামবাহাদুর পটের ছবি আঁকা শিখছে। সে বড় তুলি দিয়ে এখন কাগজে ছবি আঁকছে রাজা, ঋষি আর রাক্ষসের। বীর বলেন, ভালো করে শিখে নে আঁকাটা।নিজে আঁকতে পারলে খরচ বাঁচবে। তা না হলি চিত্রকরের বাড়ি যেতে হবে। পয়সা লাগবে বিস্তর। ছেলে রাম বলে, দেকো দিকিনি বাবা এটা রামের ছবি বটে? বীর বলে, একদিনে কি হবে রে? সময় লাগবে।এখন যতদিন বেঁচে আছি আমার কাছে শিখে লেগা। রাম বলে, তুমি রঙটা দাও গা। আমি চান করে আসি।গান গেয়ে রোজগার করা চাল আর আলু সেদ্ধ হতে বিকেল গড়িয়ে যায়। একবারে খেয়ে নেয় তিনজনে পেটভরে কারণ রাতে মুড়ি আর গুড় ছাড়া কিছু জোটে না।



বীরবাহাদুর বলে, শিল্পীরা চিরকাল ভিকিরি কেনে গো গিন্নি। গিন্নি বলেন, তাই তো হয় গো।শিল্পিরা হল সাধক। সাধকরা কি কখনও টেকা পয়সার পরোয়া করে গো?

বীরবাহাদুর কাকু বলেন, ঠিক বলেচিস তুই। পটের কাহিনীগোলা তাই তো বলে গো। পট শব্দটি সংস্কৃত পট্টি থেকে এসেছে। বর্তমানে এই শব্দটিকে , ছবি আঁকার মোটা কাপড় বা কাগজের খন্ড ইত্যাদি অর্থেও ব্যবহার করা হয়। পটের উপর তুলির সাহায্যে রং লাগিয়ে বস্তুর রূপ ফুটিয়ে তোলাই পট চিত্রের মূলকথা ।এতে কাহিনী ধারাবাহিক ভাবে চিত্রিত হতে থাকে । অন্তত আড়াই হাজার বছর ধরে পটচিত্র এ মহাদেশের শিল্প জনজীবনের আনন্দের উৎস, শিক্ষার উপকরণ এবং ধর্মীয় আচরণের অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে ।বাংলাদেশের পটচিত্রের মধ্যে গাজীর পট ও পশ্চিমবঙ্গের পটচিত্রের মধ্যে কালীঘাটের পট উল্লেখযোগ্য । পট মূলত দুই ধরনের রয়েছে। যথা জড়ানো পট, এ ধরনের পট ১৫-৩০ ফুট লম্বা এবং ২-৩ ফুট চওড়া হয়।চৌকো পটগুলো আকারে ছোট হয়।কাপড়ের উপর গোবর ও আঠার প্রলেপ দিয়ে প্রথমে একটি জমিন তৈরি করা হয়। সেই জমিনের উপর তুলি দিয়ে বিভিন্ন চিত্র অঙ্কিত হয়। আর এক রকমের চট দিয়ে কাগজের পেছনে আঠা দিয়ে আটকানো হয়। আমরা যখন ওয়াল ম্যাগাজিন, জোয়ার প্রকাশ করি তখন প্রথম ছবি কাকু এঁকে দিয়েছিলেন দয়া করে।

(ক্রমশ..)

11 views0 comments

Comments


bottom of page