সেক্রেড গ্ৰুভস খাঁটি বাংলায় পবিত্র অরণ্য ! নিশ্চয়ই অচেনা লাগছে ? ঠিক তাই। কিন্তু এ জিনিস নতুন হলেও ভারত বাংলা নয় গোটা পৃথিবীতেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সেক্রেড গ্রুভস। ন্যাশনাল পার্ক, অভয়ারণ্য, বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ-এর মতো এখনো পরিচিত হয়ে ওঠেনি সেক্রেড গ্ৰুভস। অথচ জীব বৈচিত্র সংরক্ষণের প্রাচীনতম পদ্ধতি হলো এই পবিত্র অরণ্য। যা বিজ্ঞানভিত্তিক ভাবে এখন স্বীকৃত। এই সব জায়গায় গাছের কাঠ কাটা নিষিদ্ধ। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে এই জায়গাগুলি হল সেখানকার এক-একটি ফুসফুস।
কি এই পবিত্র অরণ্য ?
প্রাচীন মানুষ উপলব্ধি করেছিলো, নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পরিবেশকে বাঁচাতে হবে। মানুষের হস্তক্ষেপ থেকে পরিবেশ কে রক্ষা করতেই পারলেই রক্ষা পাবে অরণ্য এবং গাছপালা। সেই কারণেই সাধারণ মানুষ লৌকিক উপকথা, লোককথা, সংস্কার, জনশ্রুতি এবং মিথ মিশিয়ে বন জঙ্গল অরণ্যকে বাঁচাতে চেয়েছিলো, যাতে ওই জনশ্রুতি থেকেই মানুষ ওই অরণ্য স্পর্শ না করে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা এই জিনিসের নামই দিয়েছেন সেক্রেড অর্থাৎ পবিত্র এবং গ্রুভস অর্থাৎ ছোটো অরণ্য ; এই দুয়ে মিলে সেক্রেড গ্ৰুভস!
এই অরণ্য গুলিতে ধর্মের কোনো ভেদাভেদ থাকে না, সাধারণ মানুষের যে কেউ আসা যাওয়া করতে পারেন। সামাজিক ভাবে এরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, আম, জাম, বট, অশ্বথ, বাঁশ বিভিন্ন লতা গুল্ম ঝোঁপ জাতীয় গাছ এই সব অরণ্য গুলিতে দেখা যায়। এই পবিত্র অরণ্য গুলিতে দুটি অংশ থাকে একটি অংশ অরণ্য, যেখানে হয়তো মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকে। অন্য অংশটি থাকে উন্মুক্ত সেখানে মন্দির থাকে। সেখানে মানুষজন যায়, উৎসবে পার্বনে মেলা বসে জন সমাগম হয়।
ব্রিটিশ ভারতে বন দপ্তরের প্রথম জেনারেল ডিরেক্টর ছিলেন জার্মান উদ্ভিদবিদ ডিয়েট্রিচ ব্র্যান্ডিস, ভারতের অরণ্য-বনাঞ্চলের মধ্যে তিনিই প্রথম এই ধরনের বিশেষ অরণ্য লক্ষ্য করেন। এই অরণ্য গুলোই প্রাকৃতিক ভাবে সংরক্ষিত হয়ে আছে গ্রামবাসীদের দ্বারা। যার কারণ হলো যুগ যুগ ধরে চলে আসা লোককথা, মিথ, বিভিন্ন সংস্কার ধর্মবিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে।
ব্র্যান্ডিসের নিজস্ব প্রচেষ্টায় ভারতের পরিবেশ আইনের সূত্রপাত হয়। ১৯০৬সালে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত বই "ইন্ডিয়ান ট্রিজ" আজও উদ্ভিদবিদ, গাছ প্রেমী পাঠকদের কাছে সমাদৃত। এই বইটি প্রাচীন ভারতীয় গাছেদের জানার জন্যে অন্যতম একটি সম্পদ!
কেরল, কর্নাটক, রাজস্থান জুড়ে অবস্থিত এই ধরনের একাধিক সেক্রেড গ্রুভগুলিকে চিহ্নিত করেন ব্র্যান্ডিস।
পরবর্তীতে ভারতের বিভিন্ন গ্রামগঞ্জে অরণ্যবেষ্টিত এই ধরনের একাধিক জায়গা চিহ্নিত হতে শুরু হয়। ওই অনেকটা শিবরামের দেবতার জন্মের মতো,এর মূল উদ্দেশ্য ছিল, মানুষ যাতে নিজের প্রয়োজনে গাছপালা কেটে জায়গাটিকে নষ্ট করে না দেয়। দেবোত্তর সম্পত্তি এই বিশ্বাসে রক্ষা পেতো অরণ্য এবং অরণ্য প্রাণ। ডিয়েট্রিচ ব্র্যান্ডিস সর্বপ্রথম একক প্রচেষ্টায় ভারতের সেক্রেড গ্রুভস নিয়ে সমীক্ষা শুরু করেন।
ভারতে মিজোরাম, অরুণাচল ও মধ্যপ্রদেশে ইত্যাদি রাজ্যে অরণ্যের পরিমাণ বেশি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভারতের প্রায় এক হাজার বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে সামগ্রিক ভাবে এই পবিত্র অরণ্য বিস্তৃত রয়েছে, যেমন কেরলে কাভু, ওড়িশায় জাহেরা, তামিলনাড়ুতে কইকাডু, উত্তরাখণ্ডে দেবভূমি উল্লেখযোগ্য। বন দপ্তরের তথ্যঅনুযায়ী, ভারতের মধ্যে হিমাচল প্রদেশে সরকারি ভাবে নথিভুক্ত সেক্রেড গ্রুভসের সংখ্যা সর্বাধিক।
এবার আসি বাংলার কথায়, বাংলার বিভিন্ন গ্রামগঞ্জে যে সব থান রয়েছে, সেগুলিও সেক্রেড গ্রুভসেরই প্রকৃষ্ট উদাহরণ, তাদের সঙ্গে সেক্রেড গ্রুভসের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কম-বেশি সাদৃশ্য।
মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বীরভূম, বাঁকুড়ার পল্লী বাংলায় এই রকম অজস্র জায়গা চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রধানত সাবিত্রীথান, হরিথান, শিবথান, কালিথান, বটেশ্বর, যুগীপুকুর ইত্যাদি নামেই বাংলার সেক্রেড গ্রুভস গুলি পরিচিত।
ঝাড়খণ্ড-বাংলা সীমান্ত অঞ্চল মেদিনীপুরের ডুলুং নদীর ধারে চিল্কিগড়ে একটি উল্লেখযোগ্য সেক্রেড গ্রুভ-এর উদাহরণ। কনক-দুর্গার মন্দিরকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে চিল্কিগড়ের অরণ্যসম্ভার। জীববৈচিত্র্যের জন্য সারা পৃথিবীর কাছে উল্লেখযোগ্য চিল্কিগড়, সম্প্রতি হেরিটেজ সাইটেরও তকমা পেয়েছে চিল্কিগড়। রাজ্য সরকার তরফেও একাধিক উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
চিল্কিগড়ে রয়েছে ‘এনডেমিক স্পিসিস’-এর বিপুল সম্ভার। এমন সব উদ্ভিদ , প্রাণী রয়েছে এখানে, যা অন্য কোথাও পাওয়ার সম্ভাবনা বিরল,বা নেই বললেই চলে।
কৈলাস মলহোত্র এবং তাঁর সহযোগীদের অনুসন্ধান থেকে জানা যায় যে, পশ্চিমবঙ্গে সর্বমোট ৬৭০টি এই ধরনের থান রয়েছে,যা এই পবিত্র অরণ্যকে নির্ভর করেই গড়ে উঠেছে। ভারত সরকারের "এনভায়রনমেন্ট ফরেস্ট অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ" মন্ত্রকের রিপোর্ট অনুযায়ী, এই সংখ্যাটি ৫৬২!
বর্তমানে সময়ে পৃথিবীব্যাপী বিজ্ঞানভিত্তিক ভাবে (ট্র্যাডিশনাল নলেজ ) পরম্পরাগত ধারণাকে নথিভুক্ত করার চেষ্টা চলেছে। সেই অনুযায়ী তাদের সংরক্ষণ করাও চলছে, এই সেক্রেড গ্রুভস হলো ট্র্যাডিশনাল নলেজের একটি অন্যতম প্রধান স্তম্ভ বলা যায়। ট্র্যাডিশনাল নলেজের পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় অঞ্চলে প্রচলিত দেব-দেবীর ধারণা জুড়ে তুলসী, বট, অশ্বত্থ, অর্জুন, ধুতরা, নিম, বেল ইত্যাদি গাছের উপকারিতা বুঝে নির্বিচারে বৃক্ষছেদন আটকে রাখা সম্ভব হয়েছিল। ট্র্যাডিশনাল নলেজের আর একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক হল, বিভিন্ন পশু-পাখির সঙ্গে দেব-দেবীর বাহনের সম্পর্ক গড়ে তুলে সেই সব প্রাণীর হত্যা এবং শিকার কিছুটা হলেও বন্ধ রাখা গিয়েছিলো। ফলে জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষা পেতো।
১৯৯২ সালের কনভেশন অন বায়োলজিক্যাল ডায়ভারসিটি ( CBD ) অর্থাৎ জীব বৈচিত্র সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক অধিবেশনেই প্রথম সেক্রেড গ্রুভসের ধারণা গুরুত্ব পেতে শুরু করে এবং পৃথিবী জুড়ে স্বীকৃতি পায়। প্রায় দশ বছর পরে, সেক্রেড গ্রুভসের এর বিষয়টিকে ২০০২ সালে ভারতে ১৯৭২ সালের ভারতীয় বন্যপ্রাণী প্রতিরক্ষা আইনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য গ্রুভসের মধ্যে অন্যতম হলো গ্রিসের দোদোনা অঞ্চল যা মূলত ওক গাছের অরণ্য। এখানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রাচীন গ্রিসের উপকথা। ইতালি জাপান প্রভৃতি দেশে রয়েছে একাধিক সেক্রেড গ্রুভ।
নেচার পত্রিকা গ্রুপের অন্যতম সহচর সায়েন্টিফিক আমেরিকান পত্রিকা দু -বছর আগে সেক্রেড গ্রুভসের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ও প্রয়োজনীয়তা এবং পরিবেশের সাপেক্ষে এর গুরুত্ব নিয়ে এক প্রবন্ধ প্রকাশ করে। এরপরই আধুনিক বিজ্ঞানীদের মহলের টনক নড়ে অরণ্য রক্ষার এই প্রাচীন পদ্ধতি সম্পর্কে। এক-একটি সেক্রেড গ্রুভ সেখানকার জীব বৈচিত্রের আধার , বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষক, প্রাকৃতিক ফুসফুস। তাই সেক্রেড গ্রুভসকে সংরক্ষণ করা এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রয়োজন।
কিন্তু লোকশ্রুতি ধর্মবিশ্বাস, মিথ, মন্দির, ঢিল-বাঁধা, মানত করা ইত্যাদি থাকায় এগুলোর প্রকৃত গুরুত্ব অনুধাবন না করে আমাদের একটু কপাল কুচকানোর মনভাব রয়েছে এবং এই এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতাই বিপদ ডেকে আনছে। ধর্মীয় সংস্কার থাকার জন্যে প্রাচীন কাল থেকে মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত এই লোকসংস্কৃতিই অবহেলিত থেকে গিয়েছে। এর জন্যে খানিকটা বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানমনস্কতাই দায়ি। ধর্ম বিশ্বাস কে সরিয়ে আমরা যদি পরিবেশ বাঁচানোর উদ্দেশ্য কে বড়ো করে দেখি তবেই পরিবেশের মঙ্গল।
সৌভিক রায়
Comentarios