স্বামীজী ও তাঁর প্রিয় পোষ্যরা
সৌভিক রাজ
ছোটবেলা থেকেই স্বামীজী একজন অত্যন্ত পশু-পাখী প্রেমিক মানুষ ছিলেন। পশু-পাখীর প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসা অপত্য স্নেহ ছিল।
স্বামীজীর পৈতৃক বাড়ি সিমলা স্ট্রিটে, সে তো শুধু বাড়ি নয়! যেন এক ছোটোখাটো চিড়িয়াখানা ছিল।
কি ছিল না সেখানে ? গরু, মোষ, হাঁস, হরিন, বাঁদর, ছাগল, পায়রা, ময়ূর, ইত্যাদি ইত্যাদি। নরেন এদের খুব ভালোবাসতেন এবং নিজেই তিনি তাদের পরিচর্যা করতেন এবং নিজে হাতেই খেতে দিতেন।
তারপর নরেন হয়ে উঠলেন বিবেকানন্দ। কিন্তু পাল্টালো না এই পশু প্রেমে!
বেলুড়মঠেই তিনি একইরকম চিড়িযাখানা বানিয়ে ফেলেছিলেন।
তাদেরকে অসম্ভব ভালোবাসতেন তিনি। এই পশুপাখীরাও মনের আনন্দে নির্ভয়ে সারা বেলুরমঠ ঘুরে বেড়াত। হাঁস, ছাগল, হরিণ, সারস, মোষ,কুকুর ,গাভী- কি ছিলো না সেখানে। স্বামীজী এদের প্রত্যেকের নামও দিয়েছিলেন আলাদা আলাদা করে।
একটি চিনেহাঁস ছিল, স্বামীজী সেই চিনে হাঁসের নাম দিয়েছিলেন জশোমতি । একটি রাজহাঁস ছিল, স্বামীজী যার নাম দিয়েছিলেন বোম্বাটে, ছাগলটির নাম দিয়েছিলেন মটরু আর একটা ছাগল ছিল, তার নাম দিয়েছিলেন হংসী। হংসী গলায় ছোট ছোট ঘন্টা বাঁধা থাকতো,অনবরত সেগুলি বাজত।
বাঘা আর লায়ন নামে দুটি কুকুরও ছিল। তার মধ্যে বাঘা ছিল স্বামীজীর অতি প্রিয় ও আদরের।
রাজস্থানের খেতরতে থাকাকালীন স্বামীজীর ইচ্ছানুসারে, খেতরির মহারাজ অজিত সিংহ বন্য প্রাণী সংগ্রহ করে নিজের রাজপ্রাসাদে একটি বন্যপ্রাণী সংরক্ষনাগার বানিয়ে ছিলেন।
এই এতোগুলি পোষ্যের মধ্যে স্বামীজীর সবচেয়ে প্রিয় পোষ্য ছিলো বাঘা। সে ছিলো সাধারণ ভারতীয় কুকুর।
কিন্তু প্রিয় সারমেয়ওটির উপরেও একবার বেজায় চটেছিলেন স্বামীজী। বরাহনগর থেকে স্বামীজীর জন্য পানীয় জলের কল থেকে জল আনতে হরিপদ মহারাজ। সেই জল দিয়েই স্বামীজী ঠাকুরের পুজো করতেন। স্বামীজীর প্রিয় কুকুর বাঘা একদিন সেই পূজোর জল নষ্ট করে দেওয়ায়, স্বামীজী অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে হরিপদ মহারাজকে আদেশ দিলেন, বাঘাকে মঠ থেকে তাড়িয়ে দাও। গঙ্গার ওপারে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেবার হুকুম।
যেই কথা সেই কাজ। কিন্তু লাভ হলো না !
কিছুক্ষণ পরে সেইদিনই খেয়াঘাটের নৌকার উপরে এসে বসল বাঘা। সে সময়ে মাঝিরা তাকে মঠের কুকুর বলেই চিনত। তারা বাঘাকে পার করে দিলেন। বাঘা নাচতে নাচতে স্বামীজীর কাছে গিয়ে হাজির। তিনি বাঘাকে দেখা মাত্রই রেগে গেলেন । হরিপদ মহারাজের ডাক পড়ল। সত্যি তাকে ওপারে বিদায় করা হয়েছিল কিনা জানলেন। মাঝিদের সাহায্যে সে ফিরে এসেছে, তাও জানলেন। আবার হুকুমও দিলেন, ফের ঐভাবে ওপারে দিয়ে আসতে। সঙ্গে এও বললেন যে, মাঝিদেরও যেন বলে দেওয়া হয়, তাকে ফিরিয়ে আনতে নিষেধ আছে।
ওদিকে বাঘা নাছোড়বান্দা। দ্বিতীয়বারও প্রায় একপ্রকার জোর করেই, সে নৌকায় চেপে খুঁটি গেড়ে বসলো, কিছুতেই নামবে না। লাঠির ভয়েও না। ঘেউ ঘেউ করতে লাগল। কোনো কিছুতেই তাকে নৌকো থেকে নামানোই গেলো না। মাঝিরা আর কি করবে ! ফিরিয়েই আনলো। ফের নাচতে নাচতে বাঘা মঠে উপস্থিত। স্বামীজী এবার বাঘাকে দেখে হেসে ফেললেন। জিজ্ঞাসা করলেন, " এবার কি ব্যাপার ?" সব শুনে শেষে বললেন " আর তাড়াতে হবে না যা !"
একদিন অন্ধকারে স্বামীজী বাঘার ওপর পা দিয়ে দিয়েছিলেন। সত্যি সত্যিই তিনি বুঝতে পারেননি। বললেন, " একটা বালিশ না কি পড়ে আছে দেখ তো।" কিন্তু আশ্চর্য, বাঘা ওঁকে কিছুই করেনি অন্যলোক ওরূপ করলে নির্ঘাত কামড়াত। খোকা মহারাজ একদিন রাতে বাঘাকে মেরেছিলেন। সেকথা স্বামীজীকে জানাবার জন্য বাঘা পরদিন ভোরেই ঠাকুরঘরের সিঁড়ি দিয়ে উঠে স্বামীজীর কাছে এসে উপস্থিত। স্বামীজীর পা ধরে আঁচড়-কামড় করতে লাগল। উনি তখন খোঁজ নিলেন কি ব্যাপার। খোকা মহারাজ বললেন সব ঘটনা।
বাঘার কীর্তির শেষ নেই! গ্রহণের দিন বাঘা গ্রহণ লাগার অল্প পরেই গঙ্গাস্নান করত। তারপর গ্রহণ ছাড়তে সকলের আগে মুক্তি স্নান করে নিত। যত সাহেব-সুবো মঠে আসত, বাঘাই তাদের অগ্রগামী হয়ে স্বামীজীর কাছে নিয়ে আসত। তখন গেস্ট হাউজ হয়নি। সাহেবরা ক্যাম্প ফেলে থাকত। বাঘাই ছিল তাদের প্রহরী।
বাঘাই স্বামীজীর বিশিষ্ট অতিথিদের বেলুরমঠের গেট থেকে সাদর অভ্যর্থনা করে নিয়ে আসতো।
একবার এক মজার ব্যাপার হলো। বালি মিউনিসিপ্যালিটির কর্তৃপক্ষ বিশাল ট্যাক্সের বোঝা বেলুরমঠের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল। তার জন্য হাওড়া জেলার জেলাশাসক বেলুরমঠে আসলেন তদন্ত করতে। যেই তিনি প্রবেশ করছেন, বাঘা একটি সারসকে সঙ্গে নিয়ে ছুটে গিয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা জানাল। জেলাশাসক অবাক হলেন । তিনি বললেন বহু
জায়গায় বিভিন্নভাবে অভ্যর্থনা পেয়েছি কিন্তু এইরূপ অভিনব অভ্যর্থনা পেয়ে আমি অভিভূত।
কিন্তু সব কিছুরই শেষ আছে, জন্ম যখন হয়েছে মরতে তো হবেই! বাঘা মারা যাবার পর তার শরীর গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, পরে দেখা গেল ভাঁটার টানে আবার মঠের ঘাটের কাছে ফিরে এসেছে। তারপর মঠের ধারে গঙ্গাতীরে তাকে সমাধি দেওয়া হয়েছিল।
তথ্যসূত্র : স্মৃতির আলোয় স্বামীজী : স্বামী পূর্ণ্যাত্মানন্দ মহারাজ
ছবিঃ- গুগল
Comentários