ধুলোমুঠির গান
অয়ন ঘোষ
নবম পর্ব
এখন তো মাঝে মাঝে নিজেই নিজের কাছে বোকা হয় যাচ্ছি, এই ছোট্ট বাড়িটায় এতো দিন আছি, কিন্তু চোখ মেলে দেখা হয়নি কতো কিছু। আমি নিজেও জানতাম আমার ঘরে এতো সব জিনিস আছে। তাদের কখনো হয়তো আমি নিজেই এনেছি। তারপর আর কোনো খবর নিইনি। এতটা অযত্ন, এতটা অবহেলা সহ্য হয়, বলুন। ওদেরও হয় নি। এখন প্রায় ভাবছি এই করোনা বা লকডাউন ওদের মনস্তাপেই হয়েছে। বইয়ের তাকে এমন এমন সব বই খুঁজে পাচ্ছি, যাদের এনেছিলাম অতি আদরে, কলেজস্ট্রিট ঘেঁটে। এনে একবার পড়ার পর তাকের পিছন দিকে ফেলে রেখেছি বছরের পর বছর। ধুলো জমে মলিন হয়েছে শরীর, পাতার ভাঁজে ভাঁজে অবহেলা। অভিমানও রয়েছে খুব বেশি রকমের। এখন ওদের বার করছি, আলো বাতাস পেয়ে আবার তাজা হচ্ছে শরীর। পুরনো বইয়ের একটা স্যাঁতস্যাঁতে হলুদ গন্ধ আছে, মনখারাপের গন্ধ।
মন ডুবিয়ে এখন নিচ্ছি সেই গন্ধ। হাতের ছোঁয়ায় কতো কথা কতো বার্তা। পুরনো প্রেম উথলে উঠেছে। একদিন ড্রয়ার খুলে দেখলাম খান দুয়েক পুরনো ঘড়ি, ওদের কাঁটায় থেমে আছে সময়। একটা বাবার দেওয়া মাধ্যমিকের পরে, বাবাই প্রথম দিকে পরতেন, hmt ঘড়ি। নাকের কাছে ধরলাম, সারাদিন খেটেখুটে আসা বাবার ঘামের গন্ধ পেলাম। আচ্ছা স্নেহ ভালোবাসা এসব বন্দী করে রাখা যায়! ধুলো পড়া মলিন ফোটোফ্রেম থেকে ধুলো সরালেই কিন্তু ঝাপসা ছবি গুলো কিন্তু নাড়াচাড়া করে ওঠে, গল্পগুলো আলো বাতাস পেয়ে, হাত পা ছড়িয়ে বসে। বাঁশ বাগানের মাথার ওপর যথারীতি চাঁদ ওঠে, শুধু শ্লোক বলা কাজলা দিদির কোনো পাত্তা নেই। তা আমার এখন হাল ফ্যাশনের ফ্যাসট্রাক এর ঘড়ির সাথে তাল মেলাতে না পেরে, hmt বাতিলের দলে। এরকম আর কতো কি খুঁজে পেলাম ওইখানে, যাদের একদিন আমিই সাড়ম্বরে এনে তুলেছিলাম তারপর সময় ফুরোতে ঠিকানা হারিয়েছে তারা, পুরাতন প্রেম ঢাকা পড়েছে নব প্রেমজালে। কি আর করা যাবে, এটাই দস্তুর। এটার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারলে আপনি থাকছেন স্যার, না হলে ছুটি। রোজ ঝাঁট দেবার সময় ঘরের কোণে যে ধুলো জমায় সংসার, তাতে দেখবেন ধুলোর সাথে খানিকটা স্মৃতিও জমা থাকে, আঠা ছেড়ে যাওয়া টিপ, চুলের গোছা, রঙিন কাগজের টুকরো ওই প্রত্যেক বাতিল জিনিসের মধ্যে কিন্তু আমাদের অনেক প্রিয় গল্প লুকিয়ে থাকে, মুহূর্তরা বেঁচে থাকে এমনকি ঝগড়াও বসে থাকে কথা সাজিয়ে।
ধুলোটা যত সহজে ফেলতে পারেন, ওই গল্প, মুহূর্ত, ঝগড়াগুলো ফেলা যায় না, ওরা বেঁচে থাকে, আমাদের বাঁচিয়ে রাখে।
( ক্রমশ...)
Comments