top of page
Search

১৮ই মে সংখ্যা ।। ধারাবাহিক উপন্যাস ।। ময়ূখ হালদার

agantukpotrika

পরিপ্রেক্ষিত [পর্ব ৭(খ)]


ম য়ূ খ  হা ল দা র


দুপুরে যখন বার থেকে বেরোলাম তখনও ওই দুই সন্দেহভাজন বিদেশি পেগের পর পেগ চালিয়ে যাচ্ছিল। অবশ্য বাইরে বেরোনোর সাথে সাথে তাদের কথা মাথা থেকে উবে গেল কারন তখনও আমার মাথা গোঁজার মতো কোন জায়গা ছিল না; উপরন্তু এক থালা ভাতের জন্য মন অস্থির হয়ে উঠেছিল। সারাদিনে এই একবারই ভাত খাই এবং সেটা বেশ গুছিয়েই খাই। ঠিক করলাম আগে খেয়ে নেব, তারপর থাকার ব্যবস্থা করব। গতকাল থেকেই মনটা চিকেন চিকেন করছিল। মোটামুটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং অল্প খরচে খাওয়া যাবে এরকম একটা হোটেলে ঢুকে গরম গরম ভাত আর চিকেন কারি অর্ডার দিলাম। খাওয়া-দাওয়া শেষ ক'রে যখন টেবিল ছাড়লাম ঘড়িতে তখন দুটো-পঁচিশ। এখন...থাকার জন্য একটা আস্তানা খুঁজতে হবে; কিন্তু আমার এই মুহূর্তে হাঁটতে ইচ্ছে করছে না বিশেষ ক'রে দুপুরে খাবার পর গা ছেড়ে দেয়। তখন আধাঘন্টা কাতায় না দিলে শরীরে জুত লাগে না। পা দুটোকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে এলাম ম্যালের একটা ফাঁকা বেঞ্চ পর্যন্ত। তারপর চালের বস্তার মতো বসে পরলাম ধপ ক'রে। আজ ভালোই রোদ্দুর। শীতকাল ব'লে বেশ লাগছে এই উত্তাপ। হেলান দিতেই চোখদুটো আরামে বুজে এল। মিনিট পাঁচেক পাওয়ার ন্যাপ নিয়ে সিগারেট ধরালাম। রানাঘাট কিংবা কলকাতায় হলে হেঁটে এসে সিগারেট ধরানোটা কোনো ব্যাপার ছিল না, কিন্তু পাহারের ধক আলাদা। হাঁপ ধরে। ডানপাশে, ঠিক যেখানে বেঞ্চটা শেষ হয়েছে সেখানে, এক মহিলা কফি বিক্রি করছে। দেখেই আমার ভীষণ কফি পেল।



সময় নষ্ট না ক'রে একটা জাম্বো কাপে ধোঁয়া ওঠা কফি নিয়ে ফিরে এলাম বেঞ্চে। একহাতে কফি অন্য হাতে জ্বলন্ত সিগারেট- জীবনটাকে প্যারাডাইস মনে হলো। এই এক চিলতে খুশির জন্য আমি হাজারও খুশি ত্যাগ করতে পারি! এরকম একটা মহৎ ভাবনা মাথায় আসতেই আমার মনে হলো সমতল থেকে এতটা উঁচুতে, এই মনোরম প্রকৃতির মাঝে, আমার হাত ধ'রে থাকার মতো, মন ছুঁয়ে থাকার মতো কোনো হাত নেই! এই ভয়ংকর নিঃসঙ্গতা কি সত্যিই আমি ডিজার্ভ করি? মাঝে মাঝে মনে হয়- এই বেশ ভাল আছি। আবার পরক্ষণেই ভাবি- এই একাকিত্ব কি আমার অভিশাপ নয়? ক্রমশ ডুবে যাচ্ছি ভাবনার এগজাগ্যারেশনে। ম্যাল চত্বরটা কীভাবে যেন হয়ে উঠল নন্দন কানন! সো কলড দেবরাজ ইন্দ্রের চোখে চোখ রাখতেই বমকে গেলাম! কোথায় সে? মাথায় মুকুট, গায়ে উত্তরীয়, হাতের কব্জি আর বাহুতে খাজুরাহো নক্সাকাটা বন্ধনী- এ তো আমারই হমসকল- মলয় সান্যাল, কফিকাপের জায়গায় মদের গ্লাস আর সিগারেটের বদলে অ্যান্টিক গড়গড়া! ধোঁয়া উঠছে বগবগিয়ে। ধীরে ধীরে সেই ধোঁয়াশা-কুয়াশামাখা সিলিউটের মধ্যে থেকে ভেসে আসছে পায়েলের ছমছম! কারা নাচছে ওখানে? আবছা মূর্তিগুলো একে একে স্পষ্ট হতে লাগল- তন্দ্রা, মঞ্জু, স্তুপা, ঈশিতা, সীমন্তী... ওরা কি অপ্সরাদের মতো সুন্দরী? অতোটা না হলেও, সুন্দরী তো বটে! আমার গ্লাসে মদের ছলাৎ-ছল! চারপাশে বেহালা বাদকেরা সুর তুলেছে ছড়ে! কেমন এক বুক ভার করা মেলানকলি! এমন সুর তো আমি শুনতে চাইনি। বন্ধ করো! অ্যাই কে আছো? শুনতে পাচ্ছ আমার কথা? আমি দেবরাজ ইন্দ্র, আদেশ করছি- ছিনালি বন্ধ করো! একি! মলয় সান্যাল...তুমি হাসছো? ওদের থামাবে না? না, আমি বলছি এসব থামবে না! থামবে না? না। যতক্ষণ না ওদের ছড় ভাঙবে, যতক্ষণ না ওদের পায়েল ছিঁড়বে... ততক্ষণ পর্যন্ত এই মুজরো চলবে। চলতেই থাকবে। তুমি শালা কবি না, জাত-হারামি!

-যতসব মাতালের উৎপাত! অসহ্য!



-অ্যাই! মাতাল বলছ কাকে? জানো আমি কে? আমি ইন্দ্র... দেবরাজ ইন্দ্র!

-তাই? তা এখানে কেন! যান না, ওপরে গিয়ে অপ্সরাদের নাচ দেখুন না! এটা পাবলিক প্লেস... মাতলামি করার জায়গা নয়।

লোকটা দাঁতমুখ খিঁচিয়ে উঠল! পারলে কামড়ে দেয় আর কী! আমি নিজেকে সংযত করলাম। হঠাৎ করেই চোখ লেগে গিয়েছিল। আমি কি স্বপ্ন দেখছিলাম? হবে হয়তো। কিন্তু মাতাল কথাটা বড্ড লেগেছে আমার। যাক অন্তত একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেল- গন্ডারের চামড়া নয় আমার। লোকটা কটমট ক'রে তাকিয়ে আছে এখনও। আমি চোখ গোল গোল ক'রে বললাম,

-ওভাবে তাকিয়ে থাকার কিছু নেই! থাকতে আসিনি এখানে...চলে যাচ্ছি।

আমি হাসি হাসি মুখ করে উঠে দাঁড়ালাম, তারপর দুই পায়ে এগিয়ে কী মনে হলো, ঘুরে দাঁড়ালাম।

-আপনি অন্য কিছু বলতে পারতেন... তা, না শেষ পর্যন্ত মাতাল বললেন!

এবার ঝাঁঝিয়ে উঠলো সাদা সোয়েটার,

-মাতালকে মাতাল বলবো না তো কী বলব!

আমি ভ্রু কুঁচকে ঠোঁট নাড়ালাম,

-আপনি নিশ্চিত আমাকে মাতাল মনে হচ্ছে?

-আপনি যাবেন? নাকি অন্য ব্যবস্থা নেব?

-ওকে ওকে... রাগ করছেন কেন! চলে যাচ্ছি আমি... আমি তো চলেই যাচ্ছি... আপনি বসুন না... বসুন....! আমি প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করলাম,

-চলবে?

লোকটার চোয়াল শক্ত হলো। সে জ্বলন্ত কাঠ কয়লার মতো তাকাল আমার দিকে। আমি আর ঘাঁটালাম না, সরে এলাম চুপচাপ।



অবশ্য তার মানে এই নয় যে আমি ভয় পেয়েছিলাম। আসলে আমি বরাবরই পোংটা। সকলেরই নিজস্ব কমফোর্ট জোন থাকে। যখন দেখি পরিস্থিতি কমফোর্ট জোন ক্রস ক'রে ফেলছে তখন নিজেকে সযত্নে গুটিয়ে নিই। এক্ষেত্রেও ব্যাপারটা সেরকমই ছিল। আমি ম্যাল ছেড়ে হাঁটতে শুরু করলাম। নেশার  প্রাথমিক আসর ছুটে গেল তখনই যখন আমার মনে পড়ল আমাকে একটা আস্তানার ব্যবস্থা করতে হবে। ইতিমধ্যেই যথেষ্ট সময় গড়িয়ে গিয়েছে। একটা রিজনেবল খরচে হোটেল ম্যানেজ করতে হবে। আমি আস্তাবলের লাগোয়া একটা সরু রাস্তায় নেমে এলাম। দু'পাশে মাংসের দোকান... মুরগি, খাসি, আবার কোনওটা ল্যাম্ব। তারপর খানিকটা এগোতেই চোখে পড়ল- পরপর বেশ কয়েকটি ছোট ছোট খুপরি। ঠিক যেন ক্লাবের মতো। তবে সেগুলো ক্লাব নয়, ওখানে রমরমিয়ে চলছে জুয়োর আড্ডা। প্রতিটা খোপেই একটা কি দুটো ক্যারামবোর্ড পাতা আছে। চলছে এনর্মাস বেটিং। আমি বাঁদিকে ইউবিআই হলিডে হোম ছেড়ে আরও কিছুটা এগোতেই একটা ছোটখাটো হোটেল দেখতে পেলাম।



কেন জানিনা মনে হল, এটা আমার জন্য একেবারে ঠিকঠাক আস্তানা হতে পারে। সাধারণত বাইরে বেড়াতে এসে আমার দরদামের ব্যাপারটা পোষায় না; কিন্তু এ ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অন্যরকম। যেহেতু মংলুর ওখানে থাকবো ঠিক করেছিলাম সেহেতু বাজেটেও সেই ভাবেই করা হয়েছিল। আর এখন যখন মত পাল্টেছি, তখন এই হোটেল খরচাটা বাড়তি খরচ। সুতরাং আগুপিছু চিন্তা করেই পা ফেলতে হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলার পর মনে হলো এই খরচটা সাধ্যের মধ্যেই এবং এখানেই থাকার ব্যাপারটা ফাইনাল করলাম।

(চলবে)

23 views0 comments

Comments


bottom of page