top of page
Search

২৩শে এপ্রিল সংখ্যা ।। ঈদ বিষয়ক গদ্য ।। তৈমুর খান

agantukpotrika

ঈদের ময়দান থেকে বলছি



তৈমুর খান




রোজ ভোরবেলায় জেগে যেতাম। সেহরি খাবার সময় হলেই আমার ঘুম ভেঙে যেত। তখন আর বয়স কত হবে? ওই চার কি পাঁচ বছর! ছোটবেলা থেকেই দাদা আর দাদির দুজনের মাঝখানেই আমি ঘুমাতাম। ভোরবেলায় ফজরের আজান হলেই ওরা উঠে যেতেন, আর আমিও তাদের সঙ্গেই উঠে যেতাম। এমনি করেই আমার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। বছর ঘুরে যখন রমজান মাস আসত, তখনও সেভাবেই তাদের সঙ্গে আমার সেহরি খাবার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল।


দুঃখের সংসারে সেহরি বলতে তেমন কিছুই খাবার ছিল না। সন্ধ্যেবেলায় ভাত খাওয়ার পর অবশিষ্ট যা হাঁড়ির তলায় পড়ে থাকত, তাতেই পানি ঢেলে রাখতেন দাদি। ভোরবেলায় সেই আমানি ঢেলে দিতেন। জাম বাটিতে আমানি টুকু খেয়ে নিয়ে তলায় কয়েক গণ্ডা ভাত দাদা আমাকে দিতেন। আর আমিও তা চেটে চেটে খেতাম। তখন বুঝতে শিখিনি অভাবের সংসারে এভাবে প্রায় না খেয়েই রোজা পালন কতটা কঠিন ছিল।



মাগরিবের আজান হলে ইফতার করার সময়ও দাদা-দাদির মাঝখানে বসে টুপি মাথায় দিয়ে অপেক্ষা করতাম। তেমন কিছুই খাবার থাকত না যদিও। মাঝে মাঝে প্রতিবেশীদের দেওয়া ক্ষীর অথবা কয়েক ছটাক মুড়ি। কখনো কখনো ভেজা ছোলা অথবা তেলেভাজা জুটে যেত। এভাবেই একমাস কেটে গেলে ঈদের অপেক্ষা করতাম। কবরস্থানের পাশেই বিরাট ঈদগা ময়দান। সেখানে গ্রামের মানুষ সকলেই জমায়েত হতাম। তারপর নামাজ পড়ে দৌড় দিতাম ঘরে ঘরে সালাম করার জন্য। আর সালাম করতে গিয়েই জুটে যেত নানা রকম খাবার। ঈদ তাই খুব আনন্দের হয়ে উঠত। সবাইকেই মনে হতো বড়ো আপনজন।


আজ যখন ঈদ আসে তখনো গ্রামে ছুটে যাই। ছোটবেলার সেই সব মানুষগুলি অনেকেই গত হয়েছেন। তাদের কবরগুলিও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তবুও ঈদগার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মনে মনে তাদের ডাক দেই। দুচোখ অশ্রুতে ভরে যায়। ওদের জন্য মাগফেরাত কামনা করি। তারপর চারিপাশের বিস্তৃত মাঠের দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকি। একদিন গরু-ছাগল চরিয়ে, গোবরের ঝুড়ি মাথায় এইসব মাঠে মাঠে কত ঘুরেছি। গ্রীষ্মের দুপুরে গাছতলায় বসে দু'দণ্ড জিরিয়ে নিয়েছি। ভাদ্র-আশ্বিনে ধান গাছে ফুল ধরলে জমির আল কাটিয়ে বেনা পেতে দিয়ে কত খুচরো মাছ ধরেছি। ঘাসে ঢাকা সবুজ আলগুলিতে বস্তা বস্তা ঘাস কেটেছি। সেই ঘাস বিক্রি করে কখনো কখনো কিনে এনেছি চাল অথবা চালের খুদ। কোনো কোনো দিন রান্না হয়েছে ভাত অথবা জাউ। না আমি একা নই, গ্রামের প্রায় অর্ধেক মানুষই এভাবেই জীবিকানির্বাহ করেছে। চাষাভুষো, লেট-কোনাই, দাস-মণ্ডল এবং মুসলমানরাও সকলেই এই দলে ছিলেন। একটা গরিব গ্রামের অসহায় মানুষ সবাই। ভাদ্র-আশ্বিনের কঠিন দিনগুলিতে সকলেই কপর্দকশূন্য। মাছ ধরে, কদম পেড়ে, ঘাস কেটে, জমিতে নিড়ানি দিয়ে জীবিকা নির্বাহের আয়োজন তাদের। তাদের সঙ্গে আমিও বড়ো হচ্ছি। পিতা-মাতার মুখে অন্নযোগানের ব্যবস্থা করছি।



ঈদের ময়দানে এসে অনেকক্ষণ ধরে ভাবছি। কেবলই মনে হচ্ছে, গ্রাম সত্যিই মানুষ তৈরি করে। বর্তমানে যে কলুষতা নিয়ে শহর সেজে উঠেছে তা একটা পাপেরই স্থান। অর্ধনগ্ন পোশাক পরিহিতা রমণীর ঢল। অধিকাংশই তারা বেআব্রু। কারও সঙ্গে কারোর সম্পর্ক নেই। যান্ত্রিক জীবনের দৌড় সেখানে। প্রতিটি মানুষ তার অপূর্ণতা অসহিষ্ণুতা এবং যৌনলালসা নিয়ে যেন ছুটে চলেছেন। শোষণ-পীড়ন, পরকীয়া, হত্যা, তোলা আদায় তাদের নিত্যদিনের কাজের অন্তর্ভুক্ত। রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে প্রশাসন এবং আইন-শৃঙ্খলা তাদের হস্তগত। সুবিচারের কোনো ভরসা নেই। এক অন্ধকার যুগের প্রতারণাময় উচ্ছ্বাস। শরীরী প্রদর্শনে এবং পাশবিক আস্ফালনে সবাই মত্ত। কোথায় সেই আমার হারিয়ে যাওয়া গ্রাম?


যেখানে আমি মাথায় করে খাবার নিয়ে যেতাম। আমানির থালা উল্টে গড়িয়ে পড়ত আমার শরীরে। দাদা ও বাবা মিলে ধানের বীজ তুলতেন অথবা আখের পাতা ভাঙতেন। কখনো লাঙল বইতেন। খাবার খেতে খেতেই আমার মুখেও তুলে দিতেন। কখনো গ্রামের অন্যদেরও ডাকতেন খাবার ভাগ করে খাবার জন্য। তারপর একসঙ্গে বিড়িতে টান দিয়ে আবার কাজ শুরু করতেন।


গ্রীষ্মকালে অন্যকোনো কাজ না থাকলে, পুকুর মারতেন। পুকুরের তলায় যে ঘোলা জল টুকু থাকত তা নালা কেটে তুলে ফেলতেন। তারপর পাঁকাল মাছগুলি ধরতেন। আমরা খড়কুটো কুড়িয়ে সেসব মাছগুলো পুড়িয়ে খেতাম। মাছ বেশি হলে বিক্রিও করা হতো।


কষ্টেসৃষ্টে চলত দিন। গম কাটা, গম মাড়াই করাও ছিল মাঘ-ফাল্গুনের একটি কাজ। সেই সময়ে আখ কেটে তা পিড়াবার জন্য শালও বসানো হত। কড়াইয়ে নতুন গুড় টগবগ করে ফুটত। পুরো গ্রাম গুড়ের সুগন্ধে ম ম করত। পালা করে আখ পিড়া চলত। আমরা গরু হাঁকিয়ে দিতাম শালে। রাত জেগে পাহারাও দিতাম।


ধান কাটার সময় মাঠ ঘুরে ঘুরে আমরা কেউ কেউ ধান কুড়াতাম। ইঁদুর গর্তের ধানও মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে তুলে আনতাম। ঝুড়ি ভর্তি ঝরা ধান নিয়ে এসে বাড়িতে সেদ্ধ করা হতো। তারপর সেদ্ধ ধান রৌদ্রে শুকিয়ে ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে চাল বের করতাম। সামান্য যে জমিটুকু ছিল তার ধান কেটে বিক্রি করে বাবা ঋণ শোধ করতেন। কিছু টাকা বাঁচলে নতুন কাপড় চোপড় কেনা হতো। কিছুটা গম, তিসি, তিল, আলু-পেঁয়াজ, শাক-সবজিরও চাষ করা হতো। এসব আমরা নিজেরা খেতাম এবং প্রতিবেশীদেরও দিতাম।


গ্রামে ছিল খড়ের ছাউনি দেওয়া মাটির তৈরি একটি ছোট্ট মসজিদ। সেখানেই আমরা নামাজ পড়তে যেতাম। খেজুর পাতার তালাই পেতে আমরা নামাজে দাঁড়াতাম। প্রতি শুক্রবারে বেশি ভিড় হতো। কারও গাছের প্রথম ফল মসজিদে আসত। কারও নতুন ধানের ক্ষীর। সেদিন দুই হাত পেতে এসব শিরনি নিতাম।


গ্রামটি গরিব ছিল, কিন্তু মানুষগুলি কত সুখী ছিল আজ উপলব্ধি করতে পারছি। এখনো মনে হচ্ছে, শহরের গোলকধাঁধায় এবং ভ্রান্তির জৌলুসে মত্ত না হয়ে, বরং গ্রামেই সামান্য জমি-জিরেত নিয়ে চাষ করে উপায় করা অনেক ভালো ছিল। কেননা গ্রামে আমাদের চাহিদা সীমিত। শহরে বাস করে যে লোলুপতায় আমরা আক্রান্ত হয়ে চলেছি তাতে শুধু অতৃপ্তি এবং মানসিক কষ্টই বৃদ্ধি করে চলেছে। জীবনে নেমে এসেছে কৃত্রিমতা। অনৈতিক নানা ব্যভিচারে আমরা ডুবে যাচ্ছি। সেখানে ঈমান নেই। সুন্নাহ মোতাবেক জীবনযাপন নেই। আধুনিক প্রযুক্তির কাছে নিজেদের সমর্পণ করে দিচ্ছি। হৃদয় নামক যে মানবিক ঐশ্বর্যের ভাণ্ডার নিয়ে এক সময় আমরা বড় হয়েছি, সেই হৃদয় এখন পাথর হয়ে গেছে। বরকতের ফেরেশতারা আর আমাদের কাছে আসে না। রহমতের কোনো সুসংবাদ আমরা আর পাই না। তাই আমাদের মনের মধ্যে চূড়ান্ত অস্থিরতা এবং শূন্যতা বিরাজ করে। আত্মীয়স্বজনদের কথা ভুলে যাই। তাদের সম্পর্কেও ভাটা পড়ে। এইভাবে স্বার্থপর হতে হতে, নির্বাসিত হতে হতে আমরা কোনো বিপন্নতার দিকেই এগিয়ে চলেছি। আজ অনেক গ্রামই আর গ্রাম নেই। শহরের মিশ্র কালচারে তারও চরিত্র ভ্রষ্ট হয়েছে। অতীত ঐতিহ্য স্মরণ করে হৃদয় মথিত আহ্বান আর কারও মুখেই শোনা যায় না। ঈদগাহ ময়দানে দাঁড়িয়ে ভাবতে ভাবতে অনেকক্ষণ ধরেই স্তব্ধ হয়ে গেছি। দুই চোখ বেয়ে পানি ঝরে পড়েছে নিজের অজান্তেই।


37 views0 comments

Comments


bottom of page