পরিপ্রেক্ষিত [পর্ব- ৮(খ)]
ম য়ূ খ হা ল দা র
-শ্রীবাস্তব! হামারে খাস মেহমাননে কুছ বাতায়া?
-নো স্যার।
-ঠিক হ্যায়... রুদ্র, উন দোনোকো লেকে আও।
-স্যার।
রুদ্রভানু লক আপের দিকে পা বাড়ালো, সজলকে ওরা আমার টেবিলের সামনে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। আমি ওর কাঁধে হাত রাখলাম।
-ঘাবড়াও মাত! তুনে তো কুছ ভি নেহি কিয়া! কিচ্ছু হবে না, বোস।
সজলকে হতভম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবারও বললাম,
-ভয় নেই, বোস তুই। আমি আছি তো, নাকি?
সজল নিমরাজি হয়ে বসতে যেতেই দুই বিদেশিকে দেখে সটান উঠে দাঁড়ালো। ওর চোখ দেখে মনে হল যেন ভূত দেখছে।
-শক লাগা?
আমি ওর মাথায় হাত বোলাতে লাগলাম আর সজল দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে রইলো। ওর কদম ছাঁট চুলগুলো কিছুতেই আমার মুঠোতে ধরা দিতে চাইছে না। আমি পাকাচুল বাছার মতো একটা ক'রে চুল টেনে তুলতেই ওর মুখটা লাল হয়ে গেল। দারুন শীতেও ওর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে। শ্রীবাস্তব আমার ইশারায় কাঠের হাতুড়িটা টেবিলের উপর রাখল। এ সবই পেট থেকে কথা বের করার অব্যর্থ ওষুধ। এরপর আমি সজলকে টেবিলের ওপর দুই হাতের পাঞ্জা মেলে ধরতে বলব আর এই হাতুড়ির বাড়ি মারবো নখের উপর, ঠিক যেভাবে কামারশালায় লোহা পিটিয়ে দরকার মতো স্ট্রাকচার তৈরি করা হয় আর এই পুরো প্রক্রিয়াটা অসম্ভব অসহ্য যন্ত্রণার নীল রং লেপে দেবে নখের ক্যানভাসে, সেটা অনুভব ক'রে সজলের কন্ঠার হার ওঠানামা করতে লাগলো অস্বাভাবিক পালস রেটের মতো। টর্চার রুমে বেঞ্চের ওপর উপর ক'রে শুইয়ে দুই গোড়ালিতে কিংবা মালাইচাকিতে হাতুড়ির ঘা দিলে বাঘা বাঘা অপরাধী গড়গড় ক'রে নামতা মুখস্ত বলতে থাকে আর এরা তো নেহাতই চুনোপুঁটি। হাতুড়ি হলো ব্রিটিশদের শ্যামচাঁদের মামাতো ভাই। একে ভয় পায় না এমন অপরাধীর সংখ্যা হাতে গোনা। এই মুহূর্তে ঘরে পিনড্রপ সাইলেন্স। খেদিইরা আর এডিনবার্গের মুখদুটো শুকনো মুড়ির মতো মিইয়ে গেছে। জেরার মুখে দুজনেই তাদের কৃতকর্মের কথা স্বীকার করেছে। এখন ওদের বয়ানের সাথে সজলের বয়ান মিলিয়ে নিতে হবে। পুলিশ ইচ্ছে করলে সবই পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক যে, ডিপার্টমেন্টকে সেই ক্ষমতা দেওয়া হয় না ওপরমহল থেকে। তাহলে সর্ষের ভেতরকার ভূতেরা ধরা পড়ে যাবে এবং অনেক অবিশ্বাস্য তথ্য ঝোলা থেকে বেরিয়ে পড়বে ম্যাও! তাছাড়া মানবাধিকার কমিশন তো আছেই পেছনে আছোলা দেওয়ার জন্য।
এমন অনেক কারণেই পুলিশকে হাত গুটিয়ে রাখতে হয় যা সাধারণ মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব না। তারা কারণে-অকারণে পুলিশ ডিপার্টমেন্টের সমালোচনা করতে থাকে এবং আমাদের কর্তব্যবোধ নিয়ে সওয়াল করে যদিও আমাদের অফিসার এবং কনস্টেবলদের অধিকাংশই এর জন্য দায়ী তবুও ডিপার্টমেন্টে এমন কর্মীও আছেন যাঁরা কেবলমাত্র সিনিয়রদের বা নেতা-মন্ত্রীদের স্যালুট ঠোকার জন্য জন্মাননি। তাঁরা প্রকৃতই দায়িত্বশীল কর্মী। সজল রুমাল দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে ঠোঁট নাড়ল,
-পানি...পানি দো না সাব...
জুনিয়র কনস্টেবল গিরিধারী আমার আদেশের অপেক্ষায় চোখ তুললে আমি ওকে থামিয়ে টেবিলের ওপর রাখা আমার জলের বোতলটা এগিয়ে দিলাম সজলের দিকে। সে কাঁপা কাঁপা হাতে বোতল থেকে ঢকঢক ক'রে এক নিঃশ্বাসে জল ঢালল গলায়। তারপর বোতলটা টেবিলে রেখে আমার দিকে তাকাল। এ চাউনি আমার ভীষণ চেনা। এক কথায় নতিস্বীকার বলা যেতে পারে। অনেক টালবাহানার পর সজলের মতো একবগ্গা ছেলে মুখ খুলল।
-জিন্দেগী...স্ট্রাগল...আইয়াসি... বচপন সে লে কর আজ তক... ছুটছি...শুধুই ছুটে চলেছি... দুটো মাসকলাইয়ের রুটি আর একটু সুখ... এ চাওয়া যদি গুনাহ্ হয়, তো ফির ম্যায় গুনেগার হুঁ!
সজল থামে। ওর চোখ দুই বিদেশিকে গেঁথে নিল এক ঝলক। নেতা-হাতাদের সঙ্গে ওঠাবসা করায় ওর কথাবার্তায় ঝাঁ-চকচকে ব্যাপার তৈরি হয়েছে যদিও বেশিরভাগ ক্যাডারই নিজেদেরকে চামচে গোত্রের বাইরে কল্পনাও করতে পারে না তবুও এই ছেলেটা বাকিদের থেকে আলাদা। বোঝা যায় পেটে বিদ্যা আছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সে ঠোঁট নাড়ল।
-স্যার! ওরা দু'জন আমার কথা মতোই কাজ করে। মতলব, এভাবেই অর্ডার সেট করা হয়েছিল প্রথম থেকে।
-কবে থেকে কাজ করছিস তোরা একসঙ্গে?
আমি সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে উচ্চারণ করলাম।
-আমি একাজ করছি প্রায় বছরখানেক। লোকাল বডি হিসেবে, তবে খেদিইরা, এডিন... প্রাগ থেকে ওদেরকে এদেশে পাঠানো হয় ক্যারিয়ার হিসেবে আর ওরা আমার আগে থেকেই একাজের সাথে যুক্ত।
-তুই তো বেশ ঝরঝরে বাংলা বলছিস!
আমি আরো বেশি ইন্টেন্সড হওয়ার চেষ্টা করলাম।
-স্যার! নেপালি হিন্দি বাংলা আর ইংলিশ...এই চারটে ভাষায় আমি বিন্দাস কথা চালিয়ে যেতে পারি।
-এর রহস্য?
আমার চোখ দুটো আলপিনের মত সরু হয়ে এল। -কোনও রহস্য নেই স্যার। আমার চারপাশের মানুষজন... যারা বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে... তাদের সাথে তাদের ভাষাতেই কথা বলি যাতে কারও বুঝতে অসুবিধা না হয়।
-ইমপ্রেসিভ! তারপর...?
-আমার যখন ছ'বছর বয়স তখন বাবা আমাকে আর মাকে ছেড়ে আরেকটা বিয়ে করে। মা শাল, সোয়েটার তৈরি ক'রে সংসার চালাত। আমার পড়াশোনার খরচ চালাত। আমি ওই বয়সেই বুঝে গেছিলাম অভাব কাকে বলে। মায়ের হাড়ভাঙা খাটনি সহ্য করতে পারতাম না। শুধু মনে হতো তার বুকের রক্ত জল করা টাকায় পড়াশোনা করা বা চালিয়ে যাওয়ার কোনও মানে হয় না। আমি ঠিক করলাম পড়া ছেড়ে দেবো। টাকা রোজগার করব। অনেক...অনেক টাকা। মায়ের কোনও অভাব আমি রাখব না। তারপর এলাম পলিটিক্সে। দাদাও কেন জানিনা আমাকে আপনা বানিয়ে নিল। বাকিদের থেকে আলগ নজরে দেখত আমায়। হারওয়াক্ত আগলে রাখত সিনে মে। তারপর এগারোয় পালাবদল। ফলস কমিটমেন্ট আর ধোঁকা ছাড়া এ সরকার আমাদের, পাহাড়িদের কিচ্ছু দিতে পারেনি। জি.এন.এল.এফ. সুপ্রিমো যে স্বপ্ন দেখেছিলেন একটা সময়, আমরা তাকে সাকার করতে চেয়েছিলাম। হ্যাঁ... এটা ঠিক যে দুটো দলের পলিটিকাল ভিউ আলগ; লেকিন ও(ব)সুল এক ছিল। আমরা স্বাধীন গোর্খাল্যান্ড দাবি করেছিলাম। অউর কিউ নেহি করেঙ্গে? হামারি ডিমান্ড নাজায়েস থোরি হ্যায়...যখন ইন্ডিপেন্ডেন্ট কাশ্মীর তেলেঙ্গানা নিয়ে নতুন রাজ্য তৈরির দাবি উঠছে তখন এখানে পাহাড়ের মানুষই বা পিছিয়ে থাকবে কেন?
আমি চেয়ারটা টেনে নিয়ে সজলের মুখোমুখি বসলাম। যদিও আসল জায়গা থেকে সরে সরে যাচ্ছে ওর জবানবন্দি তবুও আমি বাধা দিলাম না। আমার মনে হয় অপরাধ স্বীকারের পাশাপাশি অপরাধীর স্টেট অফ মাইন্ড এবং তার আপব্রিংগিং সম্পর্কে জানাটাও ভীষণ কার্যকরী। এতে মানুষটার সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। কেউই অপরাধী হয়ে জন্মায় না। জীবনে চলতে চলতে অপরাধমূলক কারবারে জড়িয়ে পড়ে আর শেষে একদিন দাগী অপরাধী হয়ে যায়। তার পিছনে অনেক কারণ থাকে, ঘটনা থাকে। সময় এবং পরিস্থিতি কখন যে একটা মানুষকে অপরাধী ক'রে তোলে সে কথা ঈশ্বরও জানে না! সমাজ আঙুল তুলতেই অভ্যস্ত কিন্তু সেই মানুষটার ক্রিমিনাল হয়ে ওঠার কারণ কখনোই জানতে চায় না। তার ট্রান্সফরমেশন-এর গল্প শুনতে চায় না। আর আমি এইখানটাতেই জোর দিই বেশি ক'রে। আমি সেই মানুষটাকে জানতে চাই, শুনতে চাই। ইন্টারোগেশনের সময় কেসের বাইরেও অনেক কথা হয়তো আবেগতাড়িত হয়েই অপরাধী বলতে থাকে, তাকে মাঝপথে থামিয়ে দেওয়া বা প্রসঙ্গ পাল্টে দেওয়া আমার না-পসন্দ। ক্রাইম আর পানিশমেন্ট আসলে দুটো বিপরীত প্রতিক্রিয়া, অনেকটা অংকের ফর্মুলার মতো। ক্রাইম আর ল-এর সমানুপাতিক সম্পর্কের ওপর ভিত্তি ক'রে যে বিচার নির্ধারিত হয় তার সাথে অপরাধের সম্পর্ক ব্যস্তানুপাতিক! এটাই সিস্টেম। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, সিস্টেম কখনও কোনও মানুষকে সংশোধন করতে পারেনা। এটা একটা থিওরি- আমরা প্রয়োগ করি মাত্র।
Kommentare