top of page
Search
agantukpotrika

৬ই আগস্ট সংখ্যা ।। ছোটগল্প ।। মিঠুন মুখার্জী


অতৃপ্ত জীবন


মিঠুন মুখার্জী



আমরা যা চাই তা পাই না, আর যা পাই তা নিজের না চওয়াতেই পাই। প্রত্যেকটি মানুষের মনের কোণে না পাওয়ার বেদনা লুকিয়ে আছে। কেউ প্রকাশ করে, কেউ করে না। তাই সবকিছু থাকা সত্ত্বেও জীবনে না পাওয়ার অভাব অনুভব করে অধিকাংশ মানুষ। জীবনানন্দ দাশের 'আট বছর আগের একদিন' কবিতার নায়ক যেমন সবকিছু থাকা সত্ত্বেও কোনকিছুর একাকিত্বে বা অভাবে আত্মহত্যা করেছিলেন, ঠিক তেমনি ডাক্তার রঞ্জন চক্রবর্তীর জীবন। জীবনে সুখে থাকার জন্য যা যা প্রয়োজন ঈশ্বর তাকে সবকিছুই দিয়েছিলেন। কিন্তু কেন যে সে আত্মহননের পথ বেছে নিলেন--- কেউ তা বলতে পারে না। ছোট বেলা থেকে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন তিনি । নাম-যশ-অর্থের কোন কমতি থাকবে না। বাড়ি,গাড়ি, বউ-ছেলেমেয়ে, বাবা-মাকে নিয়ে একসঙ্গে থাকার স্বপ্ন দেখতেন তিনি। বাস্তবেও তাই হয়েছিল। তবে জীবনের কোন অব্যক্ত অভাব তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিল?




              কলকাতার নামকরা স্কুলে পড়াশোনা শেষ করে জয়েন্ট এন্ট্রান্স দিয়ে রঞ্জন ডাক্তারিতে সুযোগ পেয়েছিলেন। এমবিবিএস করেন ১৯৯৫ সালে। এরপর বিলেতে যান। সেখান থেকে এফআরসিএস ডিগ্রী লাভ করে গোল্ড মেডেল পেয়ে দেশে ফিরে আসেন। তারপর আর কোনদিন তাঁকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ডাক্তারি পড়ার সময় সুস্মিতা নামের একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছিলেন তিনি। তবে তিনি এ বিষয়ে কাউকে জানতে দেননি। তাঁর সাথে ডাক্তারি পাস করেছিলেন সুস্মিতা। তারপর এ দেশ থেকেই এম.ডি করেছেন। বিলেত থেকে ফেরার এক বছরের মধ্যে তিনি এত খ্যাতি অর্জন করেন যে, তার নাম শুনলেই সকলে সম্মান করতো। নিজের বাড়িতেই চেম্বার করেন। সপ্তাহে তিনদিন রুগী দেখতেন সেখানে। আর তিন দিন দুটি নার্সিংহোম-এর সঙ্গে যুক্ত থাকতেন। এত অল্প সময়ে এত অর্থ উপার্জন করেন তিনি যা তাঁর ভাবনারও বাইরে‌। বাবা একটি বেসরকারি স্কুলে পড়াতেন। অবসর নিয়েছেন আজ পাঁচবছর হয়েছে। পুরনো বাড়ি ভেঙে ডাক্তার রঞ্জন রাজ প্রাসাদের মতো তিনতলা বাড়ি করেন। বাবা-মার সম্মতি নিয়ে বিলেত থেকে ফেরার পাঁচ বছর পর ডাক্তার সুস্মিতাকে বিবাহ করেন। তিনি বিভিন্ন জায়গায় পেসেন্ট দেখতে যাওয়ার সুবিধায় একটি আরটিকা গাড়ি কেনেন। উপার্জিত অর্থ দুই হাত দিয়ে খরচ করে তাঁর স্বপ্ন পূরণ করেন তিনি। তাঁর নাম ধীরে ধীরে সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো।



             ডাক্তার রঞ্জন ও ডাক্তার সুস্মিতার মধ্যে এতটাই ভাল বোঝাপড়া ছিল যে, কোনোদিন কোনো কারণে তাদের মধ্যে অশান্তি হয়নি। দুজনেই ব্যস্ত মানুষ হাওয়াই রান্না ও বাড়ির কাজের জন্য লোক রেখেছিলেন। তাঁরা দুজনে মিলে ঠিক করেছিলেন পাঁচ বছর পর তাঁরা বেবি নেবেন। কথা অনুযায়ী কাজও হয়েছিল। তাদের বিয়ের পাঁচ বছর পর সুস্মিতা দুটি যমজ সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। একটি ছেলে ও একটি মেয়ে। এক্ষেত্রেও ডাক্তার রঞ্জনের স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল। তাঁরা ছেলের নাম রাখেন রাজেশ্বর ও মেয়ের নাম রাখেন রজনী।


             জীবনে সুস্মিতা ছাড়া আর কারো প্রেমে পড়েন নি তিনি। এমন কি কোন নার্স  বা মহিলা ডাক্তারের সঙ্গে সম্পর্কেও জড়ান নি। তাঁকে অনেকেই বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন, কিন্তু তিনি সেগুলি প্রত্যাখ্যান করেছেন। বাড়ির কারোকে নিয়ে কখনো কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি তাঁর। সুতরাং কি কারনে তাঁর ভিতরে বাসা বাঁধা কোন টেনশন তাঁকে আত্মহত্যার পথ নির্বাচনে সহায়তা করেছিল---তা কারোর  জানা নেই। সব সুখ পাওয়ার পরও মানুষ এভাবে নিজেকে শেষ করে দেয়!!


            রেললাইনের উপর ডাক্তার রঞ্জনের বডিটা পাওয়া গিয়েছিল সকাল এগারোটা নাগাদ। ট্রেনের বীভৎস কাটা। দেখলে মাথা ঘুরে যাওয়ার মতো। পুলিশ প্রথমে ডাক্তার রঞ্জনের বাড়ির লোকেদের সঙ্গে কথা বলে ভেবেছিলেন মার্ডার‌। কিন্তু পরবর্তী সময়ে একজন প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে সব শুনে বুঝতে পেরেছিলেন---এটি আত্মহত্যা। তিনি লাইন পার হয়ে সকাল এগারোটার সময় বাজার করে যখন বাড়ি যাচ্ছিলেন, তখন দেখেন একজন স্যুট-কোট পরা ভদ্রলোক একটি এক্সপ্রেস ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দেন। এই দৃশ্য দেখে তিনি খুব ভয় পেয়ে যান। তাই সেই দিনটা সে খুব ভয়ে ভয়ে ছিলেন। এই আত্মহত্যার কারণ পুলিশ তদন্ত করে খুঁজে বার করতে পারে নি। তাঁর সাথে কারোর কোন শত্রুতাও ছিল না। কেউ তাঁকে মানসিক কোন টেনশনে ফেলে এ কাজ করতে বাধ্য করেছেন কিনা--- সে বিষয়েও তদন্ত করে পুলিশ কিছুই পাইনি। তবে কেন আত্মহত্যা !! ময়নাতদন্তে তেমন কিছুই পাওয়া যায়নি। প্রতিটি প্রাণী যেখানে বাঁচার জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিটি মুহূর্তে, সেখানে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ হয়ে কেন হেরে যাওয়া!!




                  চিরঘুমের দেশে পাড়ি দেওয়া ডাক্তার রঞ্জনের মনের কোন এক গোপন কক্ষে সবপাওয়ার মধ্যেও কোন কিছুর অভাব লুকিয়ে ছিল। যা তাঁকে জীবনে অতৃপ্তি দিয়েছিল। সেই অতৃপ্তি দীর্ঘদিন তাকে কুরে কুরে খেয়েছিল। যা হয়তো কেউ কখনো টেরই পাই নি। মানুষের জীবনে চাওয়ার কোন শেষ নেই। যাদের ভগবান যত দিয়েছেন তাদের  চাওয়ার অন্ত নেই। কারোবা সবকিছু থাকতেও জীবনের কোনো না কোনো খামতি সে অনুভব করে। যা কাছের মানুষ বা বাইরের লোক টের পায়না। নাম-যশ-অর্থ সুখ সেই অভাব- এর কাছে তুচ্ছ মনে হয়। জীবনানন্দের মতোই বলা যায় ------


                       "জানি---তবু জানি


                         নারীর হৃদয়--প্রেম--শিশু--গৃহ -- নয় সবখানি;


                         অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়--- 


                          আরো-এক বিপন্ন বিস্ময়


                         আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে


                         খেলা করে;


                         আমাদের ক্লান্ত করে


                         ক্লান্ত --- ক্লান্ত করে;"



4 views0 comments

댓글


bottom of page