ধুলোমুঠির গান
অয়ন ঘোষ
গত পর্বের পর
পাশের বাড়ির প্রতিবেশীর সাথেও কথা বলতে গেলে মুখোশ লাগছে ( এমনিতে আমরা মুখোশ পরেই থাকি, এটা আক্ষরিক অর্থেই মুখোশ) তাও আবার দূরত্ব মেপে। বারান্দা দিয়ে গরু ছাগল কুকুর পাখি ইত্যাদি নামানুষী ইতর প্রাণী গুলোকে দেখছি, রঙিন পৃথিবীতে কি মেজাজে ঘুড়ে বেরাচ্ছে। কি দারুন মস্তানি। ওদের দেখছি আর মনে হচ্ছে আমরা ওদের থেকেও দুর্বল, হীন অসহায়। মিথ্যে গর্ব করেছি এতদিন, গর্ব করার মতো আদতেই কোনো কিছু কোনো কালেই আমাদের ছিল না, আজও নেই। আবার যে দেশ গুলোকে ভাবতাম ড্রিম কান্ট্রি, সারা জীবন ছক ছক করি ওই দেশ গুলোতে যাবার জন্য আর একবার যেতে পারলেই নিজের দেশের আদ্য শ্রাদ্ধ করি, তাদের অবস্থা তো দেখছি আমার এই গরীব অশিক্ষিত দেশের থেকেও খারাপ। আজ বুঝতে পড়ছি যতটা গর্জায় ততটা বর্ষায় না, প্রবাদটা কতটা সত্যি। দূর থেকে না, সবই অমন সুন্দর লাগে! তা ওই যে বলছিলাম এই পরিস্থিতি আমার চোখে আঙুল দিয়ে বোঝালো আমার জায়গাটা আসলে কোথায়। জানি যে এই পাক থেকে বেরোলেই ভুলে যাবো কথাটা, কিন্তু নিশ্চিত জানি যদি মনে রাখতে পারি তাহলে একটু হলেও বোধহয় মানুষ হতে পারব।
তো আমরা ঠিক এতোটুকুই। তাই যতটা পারছি এই নিথর সময়ের সাথে ভেসে থাকার চেষ্টা করছি, খড়কুটো যা পাচ্ছি তাই ধরে। যখন তাও জুটছে না, তখন নিজের সাথে নিজেই গল্প করছি, ঝগড়া করছি আবার ক্লান্ত হলে সন্ধি করে নিচ্ছি, চুপচাপ। মাঝে মাঝেই বুঝতে পারছি না ঠিক কোনটা চাই, কোনটা পেলে মিটে যাবে সব আক্ষেপ। আসলে নিজেরাই তো জানি না কি চাই, সেই হিসেবের প্রশ্ন বা প্রশ্নের হিসেব যা লাভ ক্ষতির দুঃখী, অসুখী অঙ্কে ভরা। সেই খাতা সামলাতে সামলাতেই কেটে গেলো এতোগুলো বছর। দিন মাস বছরের গোলক ধাঁধায় আটকে অকালে বুড়িয়ে যাওয়াটা আমাদের ভবিতব্য বোধহয়। যুধিষ্ঠিরকে বক রুপী, ধর্ম প্রশ্ন করেছিলেন সুখী কে? উত্তর ছিল যে নিজের ঘরে, শাকান্নেই সন্তুষ্ট আর যার কোনো ঋণ নেই, সে সুখী। ১২ বছর বনবাসে প্রথম পাণ্ডব, আগামী যুদ্ধের জন্য কোনো অস্ত্র সংগ্রহ করেননি ভীমার্জুনের মতো কিন্তু অসংখ্য গুণী জনের সঙ্গ করেছিলেন, প্রশ্নের পর প্রশ্নে তাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন জীবনের অনুপান যা হয়ত কুরুক্ষেত্রের ১৮ দিনের যুদ্ধে কাজে লাগেনি, কিন্তু কাজে লেগেছে তার পরবর্তী আবহমান জীবনের। দ্রোণাচার্যের ইস্কুলের সেই ফেল করা ছাত্রটিই পরবর্তী কালের জীবনের পরীক্ষায় লেটার মার্কস নিয়ে পাশ করছেন, যার ঋণী মহাভারতউত্তর গোটা মনুষ্য সমাজ। যুধিষ্ঠিরকে করা যক্ষের প্রতিটি প্রশ্নই জীবন বোধের, কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের নয়, দেশেরও নয়। তাই মাঝে মাঝেই মনে হচ্ছে এই নিশুতি বেলা, জীবনকে দেখবার বেলা, আগামী পৃথিবীকে মন দিয়ে অনুভবের অবসর। এ সুযোগ হেলায় যেতে দিকে হবে না। নিশ্চিত জানি দেখা আবার হবেই জীবনের রাস্তায়, তখন যেনো প্রতিবেশী বা সহনাগরিককে পাশ কাটিয়ে চলে না যাই বা তাকে টপকে এগিয়ে যাবার খেলায় মেতে না উঠি। সেই রাস্তা যেনো সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকে। রঙিন কাগজের পরিচয়ে নয়, মানুষের পরিচয়ে যেনো আমাদের আলাপ দীর্ঘ নয়, বড়ো হয়। তা নাহলে কিন্তু আজকের মতো সেদিনও বলতে হবে: সুখ নেইকো মনে/ নাক ছবিটি হারিয়ে গেছে হলুদ বনে বনে।
( চলবে...)
Comments