top of page
Search

অক্ষয় সংখ্যা ।। ধারাবাহিক উপন্যাস ।। ময়ূখ হালদার


পরিপ্রেক্ষিত [পর্ব ৭(ক)]

ম য়ূ খ  হা ল দা র


রিরংসার লাশ থেকে ছিঁড়ে আনা শীৎকার

শাদা পাতায় লিবিডোর স্টেনসিল

কয়েকটা পাথরের গোলাপগাছকে

মাটিচাপা দিয়ে বেরিয়ে এলাম

গ্রেভইয়ার্ডের বাইরে


হুইস্কির গ্লাসে কয়েক ফোঁটা নোনাজল

গলা জ্বলতে জ্বলতে কখন যে পুড়ে গেছে বুক

বুঝতেই পারিনি

এ ঘরে নুন নেই কাঁচালঙ্কাও নেই

তবুও তো দিব্য বেঁচেবর্তে আছি মাল খাচ্ছি

আর চারপেয়ে চাদরের ওপর ফুলমালা চড়াচ্ছি



লেখা শেষ করে বানানগুলো চোখ বুলিয়ে নিলাম। এবার নামকরণের পালা। সাধারণত এই কাজটা আমি সবশেষে করে থাকি। মোবাইলে অভ্রতে টাইপ করার সুবিধা থাকলেও এই লেখাটা কাগজে-কলমেই লিখলাম। অনেকদিন পর সাদা পাতায় লিখে ভালো লাগছে। ভেবেচিন্তে নাম দিলাম "পাথরের গোলাপগাছ।" যাইহোক নামটা আমার বেশ মনে ধরেছে। আজকাল কবিতা খুব একটা আসে না। ধরা দেয় না।  সে একটা সময় ছিল বছর দুয়েক আগেও যখন আমি দিনে চার-পাঁচটা কবিতা নামাতাম। "কবিতা নামানো" একটা কমন ফ্রেজ। কথাটা অকসর বলে থাকি। এতেই আমি অভ্যস্ত। যদিও কিছু লোক আছে কবিতার রখওয়ালা। তারা "নামানো হয়েছে" শুনে খাপ পঞ্চায়েত বসায়, নাক সিঁটকায় আর অনেস্টলি একথা বলতে আমার দ্বিধা নেই- তাতে আমার বালও ছেঁড়া যায় না। কে ভাই তোমাদের ঠেকা দিয়ে রেখেছে! যতসব ট্র্যাশ, নীতিবাগীশ! যতদিন কবিতাকে 'ঈশ্বর' বানিয়ে রাখা হবে ততদিন পর্যন্ত কবিতার মুক্তি নেই। আরে ভাই  অ্যাড্রেলেশন পিরিওডে কোনও ছেলেমেয়েকে আটকে রাখতে পারো তুমি? ক্ষমতা আছে? হ্যাঁ, গায়ের জোরে অবশ্য তার শরীরকে বন্দি করতে পারবে। কিন্তু মন? তাকে বন্দি করবে কীভাবে? ওইসময় মন তো হ্যান্ডেল মারতে কিংবা উঙলি করতে চাইবেই এবং সেই চাওয়াটা ভীষণ ট্রুথফুল আর প্যাশনেট। কবিতাও বেরিয়ে আসতে চায়। উদ্দাম যৌনসুখ চায় সে কবির কাছে। আর সেই পিচ্ছিল মুহূর্তে তাকে জাপটে ধরা কবির দায়বদ্ধতা। তখন তুমি হড়কে গেলেই, ফুল বেলপাতা চড়ালেই সব শেষ! কিন্তু এসব কথা কাকে বলবো? কে শুনবে? কথায় আছে, "পুরুতে মন্ত্র পড়ে পাঁঠার বিচিতে শোনে!" যুগ যুগ ধরে নীতিবাগীশের দল ঠিক এভাবেই কবিতার পেছন মারছে।

জীবনে এখনও পর্যন্ত মেরেকেটে দু থেকে তিনবার সরস্বতী পুজোয় অঞ্জলি দিয়েছি। তাও ছোটবেলায়। যদিও এটা নিয়ে অনেকেই কথা শুনিয়েছে এবং এখনও শোনায়। আমি পাত্তা দিই না। ডাইমেনশন বুঝতে হবে- আমি সরস্বতীকে দেবী রূপে ভাবতেই পারি না। তার সাথে আমার হার্ডকোর প্রেমের সম্পর্ক। এখানে কোনও ভণিতা বা ন্যাকামো নেই। পুরোটাই ওপেন সিক্রেট। It's all about love making. মোদ্দা কথা হলো সঙ্গম ছাড়া সৃষ্টি অসম্ভব।



খাটের যে দিকটাতে দেওয়াল, সেই দিকটায় হেলান দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় সিগারেট ধরালাম। টানা কয়েক দিন বিরতির পর কবিতা নামাতে পেরে নিজেকে ঝরঝরে লাগছে। আসলে উপন্যাসের কাজটায় হাত দেবার পর থেকে টের পেয়েছি কবিতা বসে আছে ঠোঁট ফুলিয়ে। দুই নারীকে নিয়ে ঘর করার এই এক জ্বালা। দু'জনকেই সমান আদর করতে হবে। ওজনের কাটা একটু এদিক-ওদিক হলেই যে কোনও একটা নৌকা ডুববেই। তাল সামলানো খুবই কঠিন। তবে আমি অবশ্যই ভাগ্যবান মনে করি নিজেকে কারণ এরা যতই অভিমান করুক না কেন দু'জনের একজনও কিন্তু আমাকে ছেড়ে যায়নি। যদিও রক্তমাংসের শরীর, মেয়েদের, আমার লেখায় হাইপারবোল তৈরি করে। তবুও যে ক'টা মন, নারীর, হাতে গোনা, এসেছিল; আবার চলেও গেছে মহামারীর মতো...হয়তো আমিই বুঝে উঠতে পারিনি, তাদের, বেশিরভাগ লেখাতেই মিনিমাইজ করে রাখি। আমার অক্ষমতা। কিন্তু এটাই সত্যি।


যে হোটেলে এখন আছি সেটা ভীষণ সস্তা আর একোমোডেশনও খুব একটা আহামরি নয়। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। গুড় যেমন দেবে তেমনই মিষ্টি পাবে। ম্যাল থেকে খুব বেশি হলে মিনিট পনেরো হাঁটা পথের দূরত্ব। ফায়ার প্লেসের ব্যবস্থা নেই। পাহাড়ের ভিউও যে খুব ভালো তেমনটাও বলা যায় না। খাবার-দাবার মোটামুটি। তবে একটাই বাঁচোয়া রান্নাটা এরা নিজেরাই করে। ব্যাকওয়ার্ড স্পেস বলে এখানে ট্যুরিস্টদের ভিড় অপেক্ষাকৃত কম। তাতে অবশ্য আমার সুবিধাই হয়েছে। দিনের খানিকটা সময় নিরিবিলিতে কাটানো যায়। আমি আসলে নির্জনতাপ্রিয়। তবে সবসময় চাইলেই সেটা পাওয়া যায় না। জীবনে অনেক কিছুই আমরা চাই, সব যে পাই এমনটাও নয়। এরকম অনেক না ছোঁয়া ইচ্ছেদের সঙ্গে নিয়ে আমাদের চলতে হয়। মানিয়ে নিতে হয়। হাজারো অপ্রেশনের বুলেট ঝাঁঝরা করে দেয় বুক। মরে যেতে হয়। আর অস্ত্র বলতে সেই অবদমিত ইচ্ছে কঙ্কাল- অনেকটা সাপের বিষ দিয়ে সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসার মতো।



দার্জিলিঙে আসাটা যে প্ল্যানমাফিক, তা নয়। একঘেয়ে জীবন কাটাতে কাটাতে অরুচি ধরে গিয়েছিল। অফিস-বাড়ি, বাড়ি-অফিস করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। তাছাড়া আমার কাজটাও তো ভীষণ বোরিং। নির্দিষ্ট সময়ে ভালভ খুলে জল ছাড়া আবার ঘড়ি ধরে বন্ধ করা। খাটনি বলতে কিছুই নেই। শুধু বসে থাকা। তবে এর সুবিধাও আছে অনেক। যেহেতু লোকাল মিউনিসিপ্যালিটি তারপর বাড়ি থেকে সাইকেলে মাত্র দশ-বারো মিনিটের পথ, ট্রেন বাসের ঝক্কি পোহাতে হয় না। ফাঁকা সময়টায় দিব্যি লেখালেখি করা যায়। আমার মর্নিং শিফ্ট। আমি আর পিনাকী-আমার কলিগ, নিজেদের মধ্যে একটা সমঝোতা করেছিলাম। ছ'টা থেকে দশটা আমি সামলাই আর দশটা-দুটো পিনাকী। এভাবেই চলে আসছে। কোনও সমস্যা নেই। একেবারে হেলদি অ্যাটমোস্ফিয়ার। দশটা পর্যন্ত ডিউটির প্রধান কারণ কলকাতায় যে সমস্ত সাহিত্যের অনুষ্ঠানগুলো হয় বেশিরভাগই বিকেলের দিকে। অফিস থেকে বাড়ি ফিরে আরামসে স্নান খাওয়া-দাওয়া সেরে রওনা হতে পারি আর বেলার দিকের ট্রেনে ভিড় তুলনামূলক অনেক কম । সত্যি কথা বলতে আমার অফিস, রানাঘাট মিউনসিপ্যালিটি কখনোই সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। বরং অনেকটাই প্রচ্ছন্ন মদত অফিস থেকে পাই। এমনকি ছুটিও আমরা নিজেদের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে নিয়ে থাকি। লিখিত দরখাস্ত প্রয়োজন পড়ে না। সেটা অবশ্যই আন্তরিকতার জন্য... এটা বিশ্বাস করি চাকরি  ক্ষেত্রে এরকম পরিবেশ যে কোনও এমপ্লয়ির কাছে স্বপ্নের মতো। অনেকের কাছে আবার ঈর্ষণীয়ও বটে। গত কয়েক মাস ধরেই ভেতরে ভেতরে অধৈর্য হয়ে পড়েছিলাম। আসলে আমার আগাগোড়াই আউটিংয়ের নেশা। যেহেতু ইমার্জেন্সি ডিউটি সেহেতু বাইরে বিশেষত লং ট্রিপের ক্ষেত্রে সমস্যা হয়- এভাবেই নিজের মনকে বুঝ দিয়েছিলাম। তবুও কখনও কখনও মনটা আনচান করে। এটাও সেইরকমই একটা ফ্রেজ ছিল। নতুন উপন্যাস ধরবো ধরবো করছিলাম অথচ  হাতের কাছে সেরকম উল্লেখযোগ্য প্লটও ছিল না। তারপর হঠাৎ করেই দার্জিলিঙে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি।

(চলবে...)



45 views0 comments
bottom of page