top of page
Search

২৩শে এপ্রিল সংখ্যা ।। গল্প ।। রথীন্দ্রনাথ রায়


নামটি তাহার অঞ্জনা

রথীন্দ্রনাথ রায় প্রায় ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করার পর একটা বাস আসতেই প্রাণ ফিরে পেল অঞ্জু মানে অঞ্জনা দত্ত । স্টেটব্যাঙ্কের ধরমপুর শাখার কর্মী । প্রতিদিনই অফিসের পর বাসেই ফিরতে হয় শিকারপুরে । থাকে মহিলা আবাসনে । অন্যদিন সহকর্মী কমলা সঙ্গে থাকে । আজ সেও নেই । ক'দিনের জন্য গেছে বাপমায়ের কাছে । তাই আজ ওর বড্ড একা একা লাগছে । বাসটা আসতেই উঠে যায় সে । কিন্তু এত বেশি ভিড় যে পা রাখতে পারেনা । তবু আরও লোক ওঠে । অন্যদিন এতোটা ভিড় থাকেনা । আজ কেন এতো ভিড় বুঝতে পারেনা । বাসটা চলতে শুরু করলে কোনও রকমে পা রাখার জায়গা পায় সে । কিন্তু চারপাশের লোকগুলো যেন তাকে পিষে ফেলতে চাইছে । এরই মধ্যে একজন তাকে একটু দাঁড়াবার জায়গা করে দেয় । মনে মনে ওকে ধন্যবাদ জানাল । বেশ কমবয়সী ছেলেটা । মুখটাও মায়া মাখানো এবং মিষ্টি । অনেক কাছে সরে এসেছে ছেলেটা । ওর গায়ের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে । ছেলেটা বোধহয় সাহসী হল । একটা হাত রাখল ওর কোমড়ে । যেন কত কাছের মানুষ । না বিরক্ত হলনা । বরং ছেলেটার সাহস দেখে আশ্চর্য হল । এর আগে তাকে কেউ কখনো বিরক্ত করেনি । গায়ে হাত দেওয়া তো দূরে থাক কোনও মন্তব্য করার সাহস হয়নি । আজ এই ছেলেটার সাহস দেখে অবাক হয় সে । শয়তান ছেলে । কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটু প্রসন্নও হয় । তাহলে এখনো সে ফুরিয়ে যায়নি । এখনো সে কারোর বুকে ঝড় তুলতেই পারে । ইতিমধ্যে শিকারপুরে পৌঁছে গেল বাসটা । নামল সে । কোনও দিকে না তাকিয়েই চলতে লাগল ।

শিকারপুর ব্রাঞ্চে ট্রান্সফারের জন্য প্রায় ছমাস আগে আবেদন করেছে । ব্রাঞ্চ ম্যানেজারকে বলেছেও বারবার । তবু বদলী হচ্ছে না । ঘরে ফিরে ঘটনাটা মনে করতেই আবার হাসল সে । ছেলেটার মুখটা বেশ মিষ্টি । কত বয়স হবে ? আন্দাজ উনিশ কুড়ি । কিন্তু বেশ সাহসী । আজ থেকে বছর দশেক আগে হলে সে কিছু মনে করতনা । কিন্তু এখন ? একটা সংসারকে দাঁড় করাতে গিয়ে সে নিজের কথা ভাবেইনি কখনো । আজ আর নতুন করে তা ভাবা যায়না । আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দ্বিপদী মূর্তিটাকে ভালো করে দেখে । সহকর্মী রেবা সেন বলে তোর যা রূপ তাতে প্রমোশন পেতে দেরি হবেনা । কিন্তু সে একটু অন্যরকম । পুরুষ সহকর্মীদের হ্যাংলামো তার ভালো লাগেনা । তাই প্রায় বছর দশেক চাকরির পরেও একটা প্রমোশন জোটেনি । কমলাকে ব্যাপারটা বললে হয়তো হাসবে সে । টিপ্পনিও কাটবে । আসলে ও পুরুষদের নিয়ে খেলতে ভালোবাসে । একসঙ্গে ও অনেকের সঙ্গেই প্রেমের অভিনয় করে । পরদিনও ধরমপুর থেকে সেই একই বাসে ফিরল । সেদিন আর ততটা ভিড় ছিলনা । বাসটার চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল । না সেই ছেলেটাকে কোথাও দেখলনা । আশ্বস্ত হল আবার হতাশও হল । ঘরে ফিরতেই দেখল কমলা এসেছে । ওকে ঘটনাটা বলতেই বলল, এরকম দুএকটা রোমিও দেখা যায় বটে তবে ঘাবড়াবার কিছু নেই । দুচারদিন ওর টাকায় ফুর্তি করো তারপর ছেড়ে দাও । খেল খতম । হয়তো হয়তো আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল । কিন্তু অঞ্জনা সংলগ্ন ওয়াশরুমে যেতেই ওর আর কিছু বলা হলনা । সেদিন রাতে শোবার আগে ডায়েরিটা নিয়ে বসল । ওই ঘটনাটা নিয়ে কিছু একটা লিখলে কেমন হয় ? কিন্তু প্রায় দুঘণ্টা ভেবেও ঠিক করতে পারলনা কোথা থেকে শুরু করবে ? অগত্যা ডায়েরিটা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল । কিন্তু ইচ্ছে না থাকলেও বারবার মনে পড়তে লাগল ছেলেটির কথা । মাসতিনেক পরে বাঞ্ছিত ট্রান্সফারের অর্ডার কপি হাতে পেল অঞ্জনা । এতদিনে শান্তি । নিত্যযাত্রার ঝক্কি আর রইল না । শিকারপুর ব্রাঞ্চে ক্যাশিয়ারের দায়িত্ব পেল সে । সপ্তাহখানেক যেতেই কাউণ্টারে সেই ছেলেটাকে দেখে বুকের ভেতরটা কেমন যেন ধক করে উঠল । যণ্ত্রের মতো সই মিলিয়ে টাকাটা দিল । ইচ্ছে করলেও কথা বলতে পারলনা । অপরদিকে ছেলেটিও কোনওরকমে টাকাটা নিয়েই চলে গেল । হাসল চন্দনা । এতদিন পরে হলেও আজও মনে পড়ছে সেদিনের কথা । উইথড্রয়ালে দেখল ওর নাম অরুণ মুখার্জি । হোষ্টেলে এসে কমলাকে বলতেই বলল, দেখিস ও ঠিক এবার তোকে ফাঁদে ফেলবে । একদম পাত্তা দিবিনা । পড়ত আমার পাল্লায় বুঝিয়ে দিতাম প্রেম কাকে বলে । -- না রে, আমার মনে হয় ও সেরকম নয় । -- কি ব্যাপার বলতো ? প্রেমে পড়িসনি তো ? অপরদিকে অরুণ পড়ল মহা বিপদে । ঝোঁকের মাথায় গায়ে হাত দিয়েই ফেলেছে কিন্তু এখন ওর সামনে যেতেই লজ্জা করে । রুনুদি -- মানে মাসতুতো দিদি , একবছরের সিনিয়র হলেও সহপাঠী । কলেজে এসে শেষ পর্যন্ত ওকেই বলল ব্যাপারটা । রুনু সোল্লাসে বলল , এতদিনে তুই একটা কাজের মতো কাজ করেছিস । আমি সব ম্যানেজ করে নেব । তা বলনা, কিভাবে করলি ? রুনুদি-- মানে মাসতুতো দিদি; একবছরের সিনিয়র হলেও সহপাঠী । কলেজে এসে শেষ পর্যন্ত ওকেই বলল ব্যাপারটা । রুনু সোল্লাসে বলল , এতদিনে তুই একটা কাজের মতো কাজ করেছিস । আমি সব ম্যানেজ করে নেব । তা বলনা , কিভাবে করলি ? -- সে বলতে পারবনা ।

-- ঠিক আছে বাবা বলতে হবেনা । চল, এখন একটু ঘুরে আসি । পরপর দুটো পিরিয়ড অফ থাকায় ওরা কলেজের পিছনে দিঘির পাড় ধরে হাঁটতে থাকে । এমনিতে ওরা দুজন একসঙ্গেই থাকে । কেউ কেউ ওদের বলে জোরমানিক । ওরা গায়ে মাখেনা । রুনু ওকে বলে,তুই আমার গার্ড । তুই না থাকলে ছেলেগুলো আমাকে জ্বালিয়ে মারত । পাশ দিয়ে কয়েকটা মেয়ে যাওয়ার সময় রুনুকে উদ্দেশ্য করে বলল, চালিয়ে যা । রাবিশ ! বিরক্ত হল সে । তারপর ওকে বলল , তুই কিন্তু এখনো বলিসনি মেয়েটাকে কেমন করে পটালি ? -- এমনিই হয়ে গেছে । -- বেশ শোন, ওর সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিবি তাহলে আমি বুঝতে পারব ও সত্যি তোকে ভালোবাসে কিনা ? সেদিন কলেজ থেকে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যে হল । তারপর যথা নিয়মে রাত্রি হল । খেয়ে শুতে যাবে এমন সময় মোবাইলটা শব্দ করে উঠল । অরুণ বুঝতে পারশ অপর প্রান্তে রুনু । কে কেমন আছে জানার পর রুনু বলল , ম্যাডামকে রিং করেছিস ? -- না । -- না কেন ? তোর দ্বারা কিস্যু হবেনা । কয়েকদিন পরে ব্যাঙ্কের কাউণ্টারেই গেল রুনু । টাকা তোলা হয়ে গেলে কোনও রাখঢাক না করেই সে বলল, ম্যাডাম আপনার মোবাইল নাম্বারটা দেবেন ? -- কেন ? -- আমার এক বন্ধুর দরকার । -- কি নাম আপনার বন্ধুর ? -- অরুণ । বুঝতেই তো পারছেন । হাসল অঞ্জনা । বলল, তা উনি চাইতে পারেননা বুঝি ? লিখুন -- রুনু হেসে চলে আসে । বাইরে এসে বলে, লাইন ক্লিয়ার । এবার তোর কেরামতি । পরদিন ব্যাঙ্ক ছুটির সময়ে রুনু এসে হাজির । অঞ্জনার কাছে এসে বলে, ম্যাডাম আপনাকে নিতে এসেছি । অঞ্জনা আপত্তি করলনা । অরুণের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর থেকেই তার অতৃপ্ত আমিটা সচেতন হয়ে উঠেছে । সেই আমিটা নানা বিধিনিষেধের কথা বলেছে । অপর আমিটা বলেছে ওই বিধিনিষেধগুলো আসলে আপেক্ষিক । ব্যাঙ্কের বাইরে একটা টোটোতে অপেক্ষা করছিল অরুণ । সে অঞ্জনার ছোঁয়া বাঁচিয়ে বসার চেষ্টা করেও সম্ভব হলনা । অঞ্জনাকে নিয়ে সে অনেক ভেবেছে । অঞ্জনা ওর থেকে বেশ কিছুটা সিনিয়র । তবু ওর প্রতি একটা অদম্য আকর্ষণ অনুভব করে । কিছুতেই নিজেকে বোঝাতে পারেনা যে এটা অসম্ভব । সেই অঞ্জনা এখন আসবে তার কাছে । কিভাবে ওকে গ্রহন করবে ভেবে উঠতে পারছেনা । পাশাপাশি বসল ওরা । অঞ্জনা ওর পাশে । ওর স্পর্শ এখন অরুণের শরীরে । শ্রীভূমি পার্কে ওদের নামিয়ে দিয়ে টোটোটা চলে গেল । রুনু অঞ্জনার কাছে এসে বলল, আমি এখন অতিরিক্ত । -- তা কেন ? -- কথা বলছেন না যে? তবে চালিয়ে যান আমি আছি । অন্যদিকে চলে গেল রুনু । কি বিচ্ছুরে মেয়েটা । তবে সে তো ভেতর থেকে চাইছিল অরুণের একান্ত সান্নিধ্য । তাই আর কথা বাড়াল না । দেখল অরুণ সিঁটিয়ে রয়েছে । হাঁটতে হাঁটতে ওরা অনেকদূর চলে এল । পার্কের এদিকটায় লোকজন খুব বেশি আসেনা । তাই বেশ নিরিবিলি । থামল অঞ্জনা । বলল, আর পারছিনা । এখানেই বসা যাক । কথা বললনা অরুণ । অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করছে । কিন্তু অঞ্জনা যদি কিছু মনে করে ! এখন অনেক কাছে সরে এসেছে অঞ্জনা । না, এর আগে অনাত্মীয় কোনও মহিলা এতোটা কাছে আসেনি । অঞ্জনা ওর ডান হাতটা ধরে বলল,কি ব্যাপার কথা বলছনা যে ? কোনওরকমেওর দিকে তাকিয়ে বলল, এক্সকিউজ মি । -- কেন? -- আপনাকে বিরক্ত করেছি বলে ? অরুণ নিঃশব্দে অঞ্জনার পাশে পাশে হেঁটে চলল । বুকে হাতুড়ি পেটার শব্দ । তবু কিচ্ছুটি বলতে পারছেনা । সেদিন কেন যে বেপরোয়া হয়ে ওর কোমড়ে হাত দিল কে জানে ? আর এই মুহূর্তে রুনুটাও যে কোথায় গেল ? রাগ হল ওর ওপর । -- ও এইমাত্র । তার জন্য এতোটা ভাবছ ? হ্যাঁ করতে পারি যদি 'আপনি ' না বলে 'তুমি ' বলো ? যদিও আমি সিনিয়র তবু নাম ধরেই ডাকবে । বসল ওরা । চারদিকে নানারকমের গাছগাছালি । সেইসঙ্গে রঙবেরঙের পাখির কলকাকলি । আজ বেশ ভালোলাগে অরুণের । রুনু ওকে বলে ভীতু । কোনও মেয়েকেই নাকি ও প্রোপোজ করতে পারবেনা । আজ প্রথম সে অঞ্জনার চোখের ওপর চোখ রাখল । অঞ্জনা চোখদুটো নামিয়ে নিল । বলল , একটা কথা বলবে ? -- কি ? -- আমাকে তোমার ভালো লাগল কেন ? -- জানিনা, এমনিই । -- সেদিন বাসে আমার গায়ে হাত দিলে কেন ? যদি আমি প্রতিবাদ করতাম ? -- আসলে ভাবনাচিন্তা করে কোনও কাজ হয়না । সেদিন বাসে উঠেই মনে হল যদি প্রেম করতে হয় তো এর সঙ্গেই করব । -- আমি কি খুব সুন্দরী ? -- আমার চোখে । অরুণের এই অকপট স্বীকারোক্তি অঞ্জনার বেশ ভালো লাগে । ওকে একবার কাছে টেনে নিতে ইচ্ছে করে । তার স্বপ্নের পুরুষ আজ তার পাশে । এক অনাস্বাদিত আনন্দে তার হৃদয় অনুরণিত হয় । মনে পড়ে বিশেষ একটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের কথা । 'এদিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার ' । মনে হল অরুণই তার স্বপ্নে দেখা সেই রাজপুত্র । স্বপ্ন আর আচ্ছন্নতার মধ্যে দিয়ে দিনগুলো কেমনভাবে কেটে যায় । সবসময় শুধু অরুণের কথা মনে হয় । প্রায় মাসখানেক পরের কথা । কলেজের ফাংশানে শ্যামা নৃত্যনাট্যে অরুণকে অংশ নিতে হল । সে হল বজ্রসেন । আর রুনু হল শ্যামা । অভিনয়ের সূত্রে রুনু হল ওর গাইড । আর অরুণ ওর ছাত্র । সেদিন রিহার্সালের শেষে অঞ্জনার মোবাইল নাম্বারটা অরুণকে দিল রুনু । বলল , তুই ম্যাডামকে ফাংশানে আসতে বলবি । নাম্বারটা পেয়ে একটু ভয়ে ভয়েই রিং করল অরুণ । ও প্রান্তে অঞ্জনা । কিভাবে শুরু করবে ভাবতে ভাবতেই অঞ্জনার গলা, হ্যালো -- -- চিনতে পারছ ? -- পেরেছি । অরুণ ? -- আশ্চর্য হয়ে গেছো ? -- না । নাম্বারটা পেলে কিভাবে ? -- রুনুদির কাছ থেকে । আসল কথা হল আমাদের কলেজের ফাংশানে আগামী রবিবার তোমাকে আসতেই হবে । অরুণ এক নিঃশ্বাসে বলল কথাগুলো । গলাটা যেন শুকিয়ে কাঠ । হ্যাঁ বা না, কিছুই বললনা অঞ্জনা । ফোনটা কেটে দিল । খুব কষ্ট হল অরুণের । বুকে সাহস নিয়ে আজ অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করছিল । কিন্তু হলনা । ক্রমে রবিবারটা এসে গেল । লাস্ট মিনিটের রিহার্সাল দিতে দুপুরের দিকে রুনু এল অরুণের বাড়িতে । মাসিমা বলল, ভাগ্যিস কলেজের ফাংশানটা ছিল, তাই -- রুনু মাসিমাকে প্রনাম করে সৌজন্যমূলক কিছু কথা বলে অরুণের ঘরে আসল । অরুণ বলল , যাক ভালোই হয়েছে । শেষ দৃশ্যটা একবার ঝালিয়ে নিতে হবে । -- ওসব পরে হবে । অঞ্জনাকে ফোন করেছিলি ? -- হ্যাঁ । কিন্তু কোনও উত্তর দেয়নি । -- মানে মৌনং সম্মতি লক্ষণম । রুনু মোবাইলে রিং করে । ওপ্রান্ত থেকে অঞ্জনার গলা শোনা যায় । -- আসছেন তো ? -- হ্যাঁ । ফোনটা কেটে যায় । মোবাইলটা রেখে রুনু বলে, শুনলি তো ? ম্যাডাম আসছেন । শোন এবারে ওকে ইম্প্রেস করার দায়িত্ব তোর । -- কি করব । -- জড়িয়ে ধরবি । চুমু খাবি । তারপর -- -- তারপর কি ? -- বুদ্ধু ! একজন মহিলা আর পুরুষ যা করে তুইও তাই করবি । -- কি করে ? -- জানিনা । হাঁদাগঙ্গারাম কোথাকার । রুনু মুখ ফিরিয়ে হাসে । মনে মনে বলে, সত্যিই অরুণটা বোকা । 'শ্যামা' নৃত্যনাট্যে বজ্রসেনের ভূমিকাটা পাওয়ার পর থেকেই ক্লাসের মেয়েদের মধ্যে অরুণের দামটা একটু বেড়ে গেছে । অনেকেই ওর সঙ্গে নিরিবিলিতে কথা বলতে চায় । কিন্তু ওর ভালো লাগেনা । সবসময় অঞ্জনার কথা মনে হয় । দুপুরে ওখানেই খাওয়াদাওয়া করল রুনু । বিকেলে অরুণকে নিয়ে এল কলেজে । অনুষ্ঠান শুরু হল ঠিক তিনটেয় । পাঁচটায় শ্যামা । কলেজে পৌঁছেই ওরা চলে গেল মেক আপ রুমে । কিছুক্ষণ পরে 'শ্যামা'র সজ্জায় রুনু যখন অরুণের সামনে এল আশ্চর্য হয়ে গেল সে । শ্যামার অঙ্গে এতো রূপ ? এরূপে বজ্রসেন কেন যে কেউ পাগল হবে । তবু ওর মনে হল অঞ্জনা যদি শ্যামা হতো ? অরুণ মঞ্চের পাশ থেকে অডিটোরিয়ামটাকে দেখে নেয় । না, অঞ্জনাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না । তবে কি ও আসেনি ? রুনুকে অন্যরকম বললেও ওর মনে হয়েছিল অঞ্জনা আসবেই । কিন্তু এখন তাকে না দেখে হতাশ হল সে । অভিনয় করল বটে । তবে খুব একটা খুশি হতে পারলনা । মাঝে দুএকবার তার নৃত্যভঙ্গিমায় ভুল হলেও বজ্রসেনের সামগ্রিক প্রাণবন্ত অভিনয় এবং নৃত্যশৈলী দেখে দর্শকরা খুব খুশি হল । শ্যামা শেষ হতেই মঞ্চের বাইরে এল অরুণ । সন্ধ্যে হলেও তখনো তেমন অন্ধকার হয়ে আসেনি । হাঁটতে হাঁটতে কলেজের সামনের দিকে এল সে । হঠাৎ কৃষ্ণচূড়া গাছটার নীচে দৃষ্টি পড়তেই দেখল অঞ্জনা -- অপূর্ব রূপসী এক রমণী । যেন স্বপ্নে দেখা এক রাজকুমারী । এমন করে আগে কখনো ওকে সাজতে দেখেনি । ওর কাছে এসে দাঁড়াতেই অঞ্জনা বলল , তোমার অভিনয় দেখে আমি খুব খুশি হয়েছি । কিন্তু আমি তোমাকে আর কারোর সঙ্গে দেখতে চাইনা । -- কেন ? -- জানিনা । প্রায়ান্ধকার সেই কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় দাঁড়িয়ে অরুণ দেখল অঞ্জনার চোখে শ্যামার দৃষ্টি । ওর মনে হল অঞ্জনা নয়, শ্যামাই বুঝি তার সামনে দাঁড়িয়ে । কেমন যেন একটা বিহ্বলতা পেয়ে বসল ওকে । সে বলল , শ্যামা, আমি বজ্রসেন । আমি এসেছি । বুকের মাঝে টেনে নিল ওকে । কিছুক্ষণের মধ্যে বিহ্বলতা কেটে যেতেই অরুণ দেখল সে অঞ্জনার বুকের মাঝে । অঞ্জনা বলল, আমি তোমাকে ভালোবাসি অরুণ । আমার এ শরীর মন সবকিছু তোমার জন্য । অরুণ বলল, তুমি শ্যামা হতে পারোনা ? -- পারি । তোমার জন্য সবই পারি । শুধু একবার বলো তুমি আমাকে ভালোবাসো । অরুণ বলল , হ্যাঁ অঞ্জনা । তুমি আমারই । আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি । সেদিন রুনুকে না জানিয়েই অঞ্জনার সঙ্গে কলেজ থেকে চলে এল অরুণ । অঞ্জনাকে নিয়ে এল ওদের বাড়িতে । মায়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল । মা খুশি হলেন । মনে মনে ছেলের পছন্দের তারিফও করলেন । আবার অরুণের সম্পর্কে অঞ্জনার কাছে বললেন, ছোটবেলা থেকেই ও বেশ দুষ্টু । অঞ্জনা হাসল । মনে মনে বলল, আমিও টের পেয়েছি । রাত্রে ফোন করল রুনু । না জানিয়ে আসার জন্য বকুনিও দিল । অঞ্জনার সম্পর্কে বলল, ওই মহিলাকে একদম পাত্তা দিবিনা । অরুণ কিছু বললনা, বুঝতেও পারলনা হঠাৎ এরকম কথা কেন বলল রুনু ? অঞ্জনার ব্যাপারে ওরই তো উৎসাহ ছিল বেশি । মোবাইলটা রেখে দিল । খাওয়াদাওয়ার পরে পাশের ঘরেই থাকার ব্যবস্থা হল অঞ্জনার । ইচ্ছে হলেই ওঘরে যেতে পারে অরুণ । তবু পা দুটো যেন আড়ষ্ট । নিজের বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল । আলো নেভাতে বা দরজা বন্ধ করতেও ভুলে গেল সে ।

পাশের ঘরে অঞ্জনার মনে হল, অরুণ যদি তার কাছে আসত-- আজ ওর সান্নিধ্য পেতে খুব ইচ্ছে করছে । কিন্তু না, রাত বেড়ে চললেও অরুণ আসলনা । পরিবর্তে রাত্রি প্রায় দুটো নাগাদ পাশের ঘর থেকে কেমন যেন একটা অস্ফুট আওয়াজ আসতে লাগল । পায়ে পায়ে গিয়ে দেখল অরুণ তন্দ্রার মধ্যে তারই নাম ধরে ডাকছে । কাছে গিয়ে ওর বুকের ওপরে একটা হাত রাখতেই ওকে জড়িয়ে ধরল অরুণ । এক আচ্ছন্নতার মধ্যে কেটে গেল কিছুক্ষণ । অঞ্জনা শাড়িটা ঠিক করে নিয়ে বলল, ভুলে যাবে না তো ? -- কখনো না । তুমি ? ওর বুকে মাথা রেখে অঞ্জনা বলল, তোমাকে ভুলি সে আমার সাধ্য কি ? পরদিন সকালে অফিস আছে বলে খুব তাড়াতাড়ি অরুণের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হোষ্টেলে ফিরল অঞ্জনা । কমলা বলল, তুই মরেছিস । কোনও কথা বললনা অঞ্জনা ।মনে মনে বলল, হ্যাঁ সত্যিই মরেছি । কমলা অফিস গেলেও সে গেলনা ।সারাদিন শুয়েই রইল । খেলনা পর্যন্ত । তার মনে হয় এটা কি সে ঠিক করল ? যদিও আজকাল বিয়ের আগে এসব অনেকেই করে । কিন্তু তার মতো একটা পরিণত বয়সের মেয়ের পক্ষে এটা করা কি উচিত হল ? একটা দুশ্চিন্তা ক্রমশ ওকে গ্রাস করতে থাকে । যদি কিছু একটা হয়ে যায় ? এতদিন তো বেশ ছিল । এই বত্রিশ বছরে পৌঁছে কেনই বা এমন ভুল করল ? এটা ভুল না ঠিক তাই বা কে জানে ? ক'দিন দ্বন্দ্বের মধ্যে কাটলেও ধীরে ধীরে কিছুটা স্বাভাবিক হল সে । আবার অফিস যেতে শুরু করল । ভেবেছিল অরুণের কথা মনে আনবেনা । কিন্তু কাজের মাঝে বারবার মনে পড়ে যায় অরুণের কথা -- প্রথম দিনের কথা । অরুণ ফোন করলেও ধরলনা । ভাবল এখানেই শেষ হোক এই অসম প্রেমের আলেখ্য । ঘরে ফিরলেই কমলার টিপ্পনী -- প্রেম নয়, পুরুষদের প্রয়োজন শরীরটা । সে তো পেয়ে গেছে । সুতরাং অরুণ ভুলে গেছে তোর কথা । কিন্তু অঞ্জনা মানতে পারেনা । অরুণ তো ভুলে যায়নি । সে নিজেই তো ভুলে যেতে চাইছে । অরুণের কাছ থেকে দূরে চলে যেতে চাইছে । অরুণও কেমন যেন একটা বিষণ্ণতায় ডুবে যায় । তার কিচ্ছু ভালো লাগেনা । কলেজে এসে রুনুকেও এড়িয়ে যায় । সবসময় অঞ্জনার কথা মনে হয় । একটা ভয়ও হয় । যদি ওর কিছু একটা হয়ে যায় ? অঞ্জনা যদি তার সঙ্গে কথা না বলে ? আবার মনে হয় তা কখনো হতে পারেনা । অঞ্জনা তাকে ভুলে যেতে পারেনা । সেদিন কলেজ থেকে ব্যাঙ্কে এল । ভেবেছিল অঞ্জনার সঙ্গে দেখা হবে । কিন্তু হলনা । খোঁজ নিয়ে জানল অঞ্জনা ছুটিতে গেছে । কবে ফিরবে তাও কেউ বলতে পারলনা । ব্যাঙ্কের বাইরে আসল সে । কখন যেন চোখদুটো জলে ঝাপসা হয়ে এসেছে ।

( শেষ )



23 views0 comments
bottom of page