top of page
Search

অক্ষয় সংখ্যা ।। ধারাবাহিক উপন্যাসিকা ।। শ্যামাপ্রসাদ সরকার


চিরাগনামা

শ্যামাপ্রসাদ সরকার


                          (২)

- " লাস্ট ইয়ারে পরীক্ষার পর ওর অবসরের ছুটিতে  আমরা একবার  বহরমপুরের  বেড়াতে যাই। অবশ‍্য  তখন ওর মা মানে আমার স্ত্রী সুচন্দ্রা জীবিত ছিলেন। সেবারের ট্রীপে  হাজারদূয়ারী হয়ে মোতিঝিলের উদ‍্যানে আমরা থেমেছিলাম। সেখানকার এক বাহারী দোলনায় উঠে দোল খেতে খেতে  হঠাৎ  কমলিকা ওর  ব‍্যালেন্স হারিয়ে মাটিতে উল্টে পড়ে ও সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে যায়। মিনিট দশেক পর জ্ঞান ফিরলে ও বেশ খানিকক্ষণ ফ‍্যালফ‍্যাল চোখে  সবটা দেখছিল। বুঝতে পারছিলাম যে ও  আমাদেরকে কাউকেই ও কোনভাবে তখন  ঠিক আইডেনটিফাই করতে পারছিল না ! "

...


আফশোসের সুরে বলতে বলতে  মধ‍্য পঞ্চাশের কৃতী অধ‍্যাপক অতীন্দ্রবাবু তাঁর হালফ‍্যাশানের সোনালী চশমাটা খুলে একটু যেন উদাস হয়ে খানিকক্ষণ ঘরের জানলার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। সদ‍্য  স্ত্রী বিয়োগ ও একমাত্র মেয়ের এই মানসিক  বৈগুণ‍্যের চাপে  উনি এখন কার্য‍্যত বেশ দিশেহারা।

সুগন্ধী রুমালে মুখটা একটু মুছে নিয়ে  সবিনয়ে উনি বললেন য‍ে  মেয়ে এখন একটু সুস্থ হলেই সবটা নিশ্চিন্তি।  সামনের এপ্রিলেই  ওকে  নিয়ে ওনাদের দু'জনেরই  ভবিষ‍্যতের বাকী জীবনটার জন‍্য  বাপ-মেয়ে মিলে পাড়ি দেবেন অস্ট্রেলিয়ার  মেলবোর্ণে। ওঁর ওখানকার বিশ্ববিদ‍্যালয়ের ইন্দোলজি বিভাগে অধ‍্যাপনার আহ্বানের কথাটা পাকা হয়ে গেছে। এখন কেবল ও দেশে  যাওয়াটিই যা শুধু অনির্দিষ্টকাল ধরে  পিছিয়ে যাচ্ছে মেয়ের অসুস্থতার জন‍্য। এখন কমলিকার চলনসই গোছের সুস্থ হতে একমাসের বেশী দেরী হলে ওখানে সেটল্ করার সুযোগটি ফস্কাবে।

..

.....

আসরফী বাপকে  লুকিয়ে খিড়কীর দরজা খুলে একটু বাইরে এল। এখান থেকে একটা লালচে মাটীর শুঁড়িপথ " দাফন্ বাগে"র পথে গিয়ে মিশেছে। ও এখন একজনের খোঁজে সেদিকেই যাবে।  কিছু দিন আগে অনেক লোক লস্কর, কোম্পানীর হাবিলদার সব ওখানে এসে কোনওমতে ছিন্নভিন্ন হওয়া লাশের  ছোটে নবাবজাদাকে এসে গোর দিয়ে গেছে। যদিও ওই লাশ যে আসলে নবাবের অন‍্যায়ভাবে অবসৃত ও খুন হয়ে যাওয়া  শতচ্ছিন্ন ও ধ্বস্ত মৃতদেহ সেটা এদিনের আগে ও অতটা ভাল জানত না।

এসবের অনেকদিন পরে এটা ওকে জানিয়েছে আর এক অন‍্য আওরাত। যে কালো ওড়নায় সারাক্ষণ মুখ ঢেকে থাকে আর  ওই বাগিচার ভেতরে একটা কুটিরের ভিতরে থাকে  আর প্রায় এখানকার গোর গুলোতে রোজ চিরাগ জ্বেলে কাঁদতে কাঁদতে কুরআন শরীফ পড়ে ।

যদিও তার নাম জিজ্ঞাসা করার সাহস হয়নি

তবে তার সেই নিবিষ্ট কন্ঠের মোনাজাত  ওখানে  এন্তেকালের পর ঘুমিয়ে থাকা সব মূর্দাদের সবাইকে  বেহেস্তের পথে রওনা করার জন‍্য রোজ  দোয়া চাইতে বসে। আর তার প্রার্থনার সেই সুরের চিকন মেজাজটিও যেন তার সাথে নিয়ে খানখান হয়ে ছড়িয়ে যায় কাছেই বয়ে চলা  ভাগীরথীর স্রোতে।

.......

বুঝতে হয় যে একজন মসনদের মালিক বদলে গেলে ফেলে আসা  সবকিছুরও তার সাথে  হাল হকিকৎও বদলে যায়।

নইলে বঢ়ে নবাব  আলীবর্দী খাঁর পেয়ারের সেই " খুশবাগ্" এর ফুল-ফলের সাধের বাগিচা আজ পরিবারের সবার লাশের "দাফন্ বাগে" বদলে যাবে কেন?  তবে আসরফী  " নিমকহারাম দেউড়ী "তে ঘটে যাওয়া কিসসাটা ওই আজনবী খিদমৎগার বিবিজানের কাছে না শুনলে সবটা জানতে পারত না।

....

ওই বিবিজানের ঘুম জড়ানো গলায় বলতে থাকা হাজারো নবাবী কিসসা ওকে যেন যাদু করেছে। তাই সে  প্রায়সই বাপের চোখ এড়িয়ে  দাফনবাগে আসে আর সেই বিবিটির কাছে বসে এসব দুঃখের কিসসাগুলো শোনে, তখন যেন ওর সদ‍্য কৈশোরত্তীর্ণ মনটা অনেকদূরে.....প্রায় সিন্দবাদের মত এক অলীক একটা দেশে অবলীলায় ঘুরে মরে। বিবিজান ওকে আজ বিশেষ করে যেতে বলেছে বলেই  এতক্ষণ পরে ও দুপুরের একটু সুযোগ পেতে সে ওখানে যাবে বলে বেরিয়ে এল।

( ক্রমশ...)



10 views0 comments
bottom of page