top of page
Search

অল্প কথার গল্পে শর্মিষ্ঠা সাহা


অচেনা আরশি

শর্মিষ্ঠা সাহা।




দেয়ালে টাঙানো চৌকনা কাঁচের সামনে দাঁড়িয়ে আছে রানী , সদ্য পা ধুয়ে এসেছে তার জলছাপগুলোর প্রতিচ্ছবি দৃশ্যমান আর ধীরে ধীরে বাষ্পীভূত হয়ে যাওয়াটাও গোচর। দ্বিধাবিভক্ত মনের দ্বন্দ্ব কাটাতে জন্মের দাগ রেখে দিল আয়নার ধুলোয়। এখন রক্তে শুধুই বিধুর । বুদ্ধিদীপ্ত চোখের জ্যোতিটুকুনি রেখে দিল টেবিলে রাখা কলমের জিম্মায়। নিষ্প্রভ সবটাই । আস্তে আস্তে কাঠের দেরাজটা খুললো , বের করেছে মেরুন শিফন, সকালেই কিনে আনা। কিছু টাকা অ্যাডভান্স পেয়েছে। হোস্টেলের ঘরে এখন রুমমেট নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস চলছে এখনো। গোধূলীর ধূলি ভরিয়ে দিচ্ছে রানীর অন্তরী , তুই ধুলোর মেহেক নে , আমার বাহির মুক্ত হোক।


মেরুন শিফনখানা জড়িয়ে নিল বাইশের নিটোল তরুণীর শরীর , খাঁজে খাঁজে কেটে বসছে , ঠিকড়ে বেরোচ্ছে চামড়ার গোলাপিসুধা। বো কাট স্লিভলেস ব্লাউস আর ঘাড় থেকে নেমে আসা লম্বাদড়ির বাঁধন সাথে হালকা নিক্কনসম শব্দযুক্ত ঝুনঝুনি খানিক রিনরিন শব্দ ছড়ালো ঘরবায়ুতে । ক্ল্যাচার দিয়ে ঘন কালো চুলগুলো ওপরে আটকে নিল । কানের রুপোর মাকরিটা খুলে ড্রয়ারে রেখে লম্বা মেরুন ট্যাসেলের দুলটা ঝুলিয়ে দিল, ছুঁয়ে যাচ্ছে গোলাপি গ্রীবাবন্ধন। ব্লাসার শেষে সরু গোলাপি ঠোঁটটায় ডার্করেড লিপগ্লস আর মৃগণয়নাতে কলোসিয়াল কাজল বুলিয়ে একটু দাঁড়ালো , হাঁপ নিল। এর থেকে বেশি সাজার কারিকুরি তো জানা নেই । এটাও কালকেই শিখেছে। অবশ্য জগদা বলেছেন কিছু না সাজলেও চলবে। হাতঘড়িটা একবার দেখে নিল , সাড়ে পাঁচটা। বেরোতে হবে। সৃজনী চলে এলে অত প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া সম্ভব না। কালো নেইলপলিশ লাগানো পা টা জুতোয় গলিয়ে কাঁধে ভ্যানিটিটা ঝুলিয়ে নিল। সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এলো , সোজা অফিসরুমে।

-- তৈরি। হম , ঠিক আছে। গাড়িতে উঠে চুলটা খুলে দিও। ওই খোলা চুলেই তুমি প্রথম নজর টেনেছিলে , শকুনের নজর।

সেই বিকট খ্যাঁকখ্যাঁক হাসি। কিন্তু আজকে রানীর বিরক্ত লাগলো না। টাকাটা খুব দরকার।

-- হম। যাচ্ছি তাহলে।

-- আসি বলো। দুগ্গা দুগ্গা। এগিয়ে যাও , সামনের বাদিকের মুখে সাদা সুইফ্ট দাঁড়িয়ে আছে। নাম্বার 3645। উঠে যাও। বলা আছে। সকালে ওটাই পৌঁছে দেবে।

-- সৃজনী ?

-- আমি সামলে নেব।

গলির মুখে পৌঁছে গাড়িতে উঠে রানী ক্ল্যাচারটা খুলে দিল। একঝাঁক চুল সরসরিয়ে নেমে এলো কানের পেছন দিয়ে গাল ঠোঁটের ওপর। চোখ বন্ধ করে একবার মনে করতে চাইলো মায়ের আর বোনের মুখটা। কিন্তু সবার আগে বাবারটাই ভেসে উঠলো। কেমোথেরাপিতে কঙ্কালসার একটা দেহ , তবু শ্বাস চলছে , বাবা বলে ডাকলে কেউ উত্তর দেয় না।

মায়ের ফোন এসেছিল গত সপ্তাহে , বাবার কেমো চালানোর জন্য আর টাকা নেই বেশি। অফিস থেকে যা পাওয়া যেত সবটা ব্যয় হয়ে গিয়েছে আগের চার বারে। বোনের জয়েন্টের রেজাল্ট বেরিয়েছে , ভর্তির খরচ অনেক। মা বলছিল , মা কাঁদছিল। সে আর্তি যে কি নিদারুণ তা রানী বুথের টেলিফোনে দিব্য টের পাচ্ছিল। গাড়িটা ডিসব্রেক চেপেছে , রানী সামনের ড্রাইভারের সিটের পেছনে হুমড়ে পড়লো , মুখ তুলতেই কানে এলো

-- ইস , ভাবলাম সিগন্যালটা পেরিয়ে যাবো, হলো না। আবার দশ মিনিটের ধাক্কা ।

রানীর কথা বলবার ইচ্ছা হলো না। আবার মগ্নতায় ডুবে গেল মন। গতবছরের জুনের নেট টা ক্লিয়ার করতে পারলাম না। করতে পারলে রিসার্চ স্কলারশিপটা পাকা হয়ে যেত। তাহলে এবার ডিপার্টমেন্টেই ম্যাডামের কাছে জয়েন করতাম। আর কিছু সাহায্য করতে পারতাম বাড়িতে। এখন যা অবস্থা তাতে এবারের ফর্ম তোলার পাঁচশ টাকা চাইতে পারবো না মায়ের কাছে। টিউশনের টাকা দিয়ে হোস্টেল খরচ মেটাই , বাকিটা পড়ার খরচ।

গাড়িটা স্পিডে চলছে। অফারটা এসেছিল গত পরশু। হোস্টেলে ফোন এলো মায়ের।

-- রানী , সোনা মা দ্যাখ না কোনো এক্সট্রা টিউশন পাস নাকি। আমি গয়নাগুলো দিয়ে বাবার কেমো করানোর খরচ এনেছি , কিন্তু বোনের টাকাটাও লাগবে। সাথে সংসার খরচ। বাবার পেনশনে এবার হবে না। যদি কিছু পাঠাতে পারিস।

-- হ্যাঁ ,মা। তুমি চিন্তা করো না। আমি দেখছি। বোন ভর্তি হবেই। আমি আমার বন্ধুদের কাছ থেকে নিয়ে পাঠাবো , পরে আস্তে আস্তে ফেরৎ দিয়ে দেব।

যদিও জানে এরকম সাহায্য করবার কেউ নেই। ফোনটা জগদা শুনছিল বাইরে থেকে। লোকটা অনেকদিন থেকেই লোভাতুর দৃষ্টিতে দেখে। গা শিরশির করে ওঠে ওই নজরে। তারপর গতকাল ফেরার পথে সেই ঘ্যাসঘ্যাসে গলায় গেটের সামনে কথাটা বলেই দিল। অনেকগুলো টাকা পাবো। একবারেই। আমার মাথা কাজ করছিল না , কি করবো , কেমন করে সবটা সামলাবো। সব দীপগুলো নিভে যাচ্ছিল , কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমি রোবটের মত সম্মতি দিয়েছিলাম।

-- ম্যাডাম , ম্যারিওট এসে গেছে। আমি আপনাকে ভোর পাঁচটার দিকে কল করে নেব।

-- হ্যাঁ

রানী নেমে এল। এত বড় হোটেল কখনো ও আগে দেখে নি। লাউঞ্জ , বাফে , মিটিং জোন , শ্যাম্পেন , সাদা ধবধবে বিছানা , কার্লোন , তাতে চাক্কি পেশাই হলে পিঠে ব্যাথা লাগে না। বাথটাব ,উষ্ণস্নানের শেষে লোনা জল গড়িয়ে পড়লেও রানী দেখতে পেল বোনের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া চলছে , বাবার সেই স্মিত সম্ভাষণ " রানী , পাটরানী " , মায়ের গায়ে সেই জামদানিটা আর নিজের রিসার্চ পেপার রেডি করছে। নামের আগে ডক্টর লাগাতেই হবে। বাবার স্বপ্ন যে ওটা ।

72 views0 comments
bottom of page