top of page
Search

আগন্তুক ।। কবি প্রণাম সংখ্যা ।। প্রবন্ধ ।। হিমাদ্রি শেখর দাস 


হিমাদ্রি শেখর দাস 

দীর্ঘ সাহিত্যজীবনে নানা বিষয়ে বিবিধ আঙ্গিকে সাহিত্যচর্চা করলেও, রবীন্দ্রনাথ কবি হিসেবেই বেশী  পরিচিত। রবীন্দ্রনাথের সময়ে যাঁরা কবিতা লিখেছেন, যাঁরা পরিচিতি পেয়েছেন রবীন্দ্রানুসারী কবি হিসেবে, তাঁদের পক্ষে অনিবার্য ছিলো রবীন্দ্রনাথের অনুকরণ এবং একই সঙ্গে অসম্ভব ছিলো রবীন্দ্রনাথের অনুকরণ। বিশ শতকের প্রথম দুই দশকে বাঙালি কবির কাছে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব ছিলো উপদ্রবের মতো। কিন্তু প্রলোভন দুর্দম হলেও রবীন্দ্রনাথের অনুকরণ তাঁদের পক্ষে ছিলো দুঃসাধ্য। ফলে তাঁর প্রবল দীপ্তির জোয়ারে অনেকেই হারিয়ে গেছেন, অনেকেই নির্মাণ করতে পারেননি নিজস্ব কোনো দ্বীপভূমি। প্রায় সকলেই এদিক-সেদিক ঘুরে-ফিরে শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের কবিতা-উপনিবেশেই আশ্রয় নিয়েছেন, রাবীন্দ্রিক কবিতাকাশেই তাঁরা ছড়িয়ে দিয়েছেন তাঁদের সাধনার শ্রেষ্ঠ তারামালা।

রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতায় রবীন্দ্রনাথের ব্যাপক প্রভাব পড়েছে যে সব প্রান্তে তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় নিম্নবর্গের জীবনচিত্রায়ন, আদিবাসী জীবনের প্রতি ভালোবাসা, রাজনীতি সচেতনতা, কবিভাষা, ছন্দোপরীক্ষা প্রভৃতি প্রবণতা। বর্তমান সময়ে বাংলা কবিতায় নিম্নবর্গ এবং আদিবাসী জীবন বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায় প্রাধান্য লাভ করেছে।  অবাক  হতে হয়, এত বছর আগে রবীন্দ্রনাথ ‘পুনশ্চ’ কাব্যে আদিবাসী জীবন নিয়ে কবিতা লিখেছেন, কবিতা লিখেছেন নিম্নবর্গের জীবন নিয়ে। তাঁর রাজনীতি সচেতনতার কথাও বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কবি রবীন্দ্রনাথের যে ভূমিকা, উত্তরকালে তা-ই বাংলা কবিতায় মহীরুহ হয়ে দেখা দিয়েছে। কাজী নজরুল ইসলাম রবীন্দ্রনাথের ‘১৪০০ সাল’ কবিতার প্রত্যুত্তরে যখন লেখেন ‘১৪০০ সাল’ নামের কবিতা, তখনো তো ভিন্নমাত্রিক এক প্রভাবের কথা আমরা মনে করতে পারি। উত্তরকালীন বাংলা কবিতাকে রবীন্দ্রনাথ সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছেন কবিভাষা দিয়ে। বাংলা কবিতায় এখনো রবীন্দ্র কবিভাষার বিপুল প্রভাব প্রবহমান। এখনো অনেক কবি রবীন্দ্রনাথের কবিভাষায় কবিতা লিখে খ্যাতি অর্জন করছেন। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের নানামাত্রিক ছন্দোপরীক্ষার কথাও আমরা উল্লেখ করতে পারি। ‘বলাকা’ কাব্যের মুক্তক ছন্দ, আর ‘পুনশ্চ’-এর গদ্যছন্দই তো এখন বাঙালি কবির ভাবপ্রকাশের বিকল্পহীন অবলম্বন। কবিতায় চিত্রলতার যে প্রকাশ, যা ব্যাপকভাবে দেখা যায় জীবনানন্দ দাশের কবিতায়, সেখানেও আছে রবীন্দ্রনাথের অলঙ্ঘনীয় প্রভাব। কবিতায় আন্তর্জাতিক ভাব-পরিমণ্ডল সৃষ্টির প্রাথমিক প্রতিশ্রুতিও আমরা রবীন্দ্র-কবিতাতেই প্রথম লক্ষ করি। স্মরণ করা যায়, রবীন্দ্রনাথের ‘আফ্রিকা’ কবিতা রচনার পর তৈরি হয় বুদ্ধদেবের ‘ছায়াচ্ছন্ন হে আফ্রিকা’। ‘লিপিকা’ এবং ‘পুনশ্চ’ কাব্যে কবিতায় গল্প বলার যে ঢং, তা-ও আমাদের শিখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, উত্তরকালে যা ব্যাপকভাবে চর্চিত হয়েছে। একইভাবে  দেখা যায়, রবীন্দ্র-উত্তরকালে বাংলা কবিতার ভাব-পরিমন্ডল , সংগঠন নির্মিতি এবং কবিভাষা- সর্বত্রই প্রবলভাবে উপস্থিত আছেন পরাক্রমশালী রবীন্দ্রনাথ।

রবীন্দ্র-বলয়বন্দি এই কবিদের মধ্যে আছেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, কালিদাস রায়, গোবিন্দ্রচন্দ্র দাস, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, মোহিতলাল মজুমদার, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় প্রমুখ। বলতে দ্বিধা নেই, কিছু স্বাতন্ত্র্য থাকলেও এঁরা মূলত রবিশস্যেই লালিত-পালিত বর্ধিত। রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার কিংবা অতিক্রমের স্পর্ধিত কোনো প্রয়াস এঁদের ছিলো না, উনিশ শতকী রবীন্দ্র-রোমান্টিকতাই তাঁরা চর্চা করলেন বিশ শতকের প্রথমার্ধেও- ‘বলাকা’ উত্তর রবীন্দ্র-কবিতা আত্তীকরণেও তাঁরা হলেন । ব্যর্থ। দেশকালের দ্বন্দ্ব ও সংক্ষোভ, সভ্যতার সঙ্কট তাঁদের বিচলিত করেনি, তাই রাবীন্দ্রিক স্বদেশপ্রেম ও প্রকৃতিলোকে এঁরা নিশ্চিন্তে কালাতিপাত করে নির্মাণ করেছেন কবিতার পর কবিতা। বস্তুত, তাঁদের এই পরিণাম ছিলো ইতিহাস-নির্ধারিত

আধুনিক বাংলা কবিতায় রবীন্দ্রনাথের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন: ‘‘রবীন্দ্রনাথে কোনো বাধা নেই- আর এইখানেই তিনি সবচেয়ে প্রতারক-  তিনি সব সময় দু’হাত বাড়িয়ে কাছে টানেন, কখনো বলেন না ‘সাবধান! তফাৎ যাও!’’

 রবীন্দ্রনাথের প্রভাব যে কতো ব্যাপক, তা বোঝা যায় তখন, যখন দেখি রবীন্দ্রনাথের বাক্যবন্ধ ধার করেই বুদ্ধদেবকে নির্মাণ করতে হয় তাঁর বিবেচনা। বস্তুত, রবীন্দ্রোত্তর কালে এমন কোন বাংলাভাষী লেখক আছেন, যিনি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রবীন্দ্রনাথ দ্বারা প্রভাবিত হননি? এই প্রভাব কখনো পড়েছে সাহিত্যের ভাব-পরিমণ্ডল সৃজনক্ষেত্রে, কখনো বা সংগঠন নির্মাণে, কখনো বা আঙ্গিক নির্মিতিতে। লেখার অপেক্ষা রাখে না যে, কোনো কোনো সাহিত্যিক রবীন্দ্র প্রভাব থেকে কখনো মুক্তি পাননি, আবার কেউ বা তৈরি করে  নিয়েছেন নিজস্ব জগত ।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে ত্রিশোত্তর কবিদের রবীন্দ্র-বিরোধিতার কথা বহুল প্রচারিত। প্রবল প্রাণ তিরিশি কবিদের সচেতন রবীন্দ্র-বিরোধিতা কি পরোক্ষে রবীন্দ্র প্রভাবেরই নির্ভুল স্বাক্ষর নয়? প্রভাব না পড়লে, তাঁকে অতিক্রমণের বাসনা জাগ্রত হয় কীভাবে? লক্ষ করলেই দেখা যাবে, তিরিশের কবিরা যখন চল্লিশে পা রাখলেন, তখন রবীন্দ্র-বিরোধিতার পরিবর্তে তাদের কবিতায় এলো রবীন্দ্রস্মরণ। কেউ কবিতা-সংকলনের নামকরণ করলেন ‘তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ’, কেউবা রবীন্দ্র সাহিত্য থেকে ঋণ করে নির্বাচন করেছেন গ্রন্থ নাম, কেউবা রবীন্দ্রনাথকে গ্রন্থ উৎসর্গ করে প্রকাশ করেছেন সার্বভৌম ওই কবির প্রতি গভীর আনুগত্য।  এই  প্রসঙ্গে স্মরণ করা যায় পিনাকেশ সরকারের মতামত: -"চতুর্থ দশকের তরুণ এই কবিবৃন্দের প্রায় সকলেরই কাব্য প্রেরণা গড়ে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথের কবিতাপাঠের দ্বারা। বিদেশী কবিতার নানা উপাদানকে সময় থেকে সময়ান্তরে ব্যবহার করলেও রবীন্দ্র প্রভাব তাঁরা কেউই প্রায় অস্বীকার করতে পারেননি তাঁদের প্রাথমিক কাব্য প্রয়াসে, আর সেটিই ছিল খুব স্বাভাবিক এবং প্রত্যাশিত।"

 বুদ্ধদেব বসুর কথায় :-‘বাঙালি কবির পক্ষে, বিশ শতকের প্রথম দুই দশক বড়ো সংকটের সময় গেছে। এই অধ্যায়ের কবিরা- যতীন্দ্রমোহন, করুণানিধান এবং আরো অনেকে, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত যাঁদের কুলপ্রদীপ, যাঁরা রবীন্দ্রনাথের মধ্যবয়সে উদ্গত হয়ে নজরুল ইসলামের উত্থানের পরে ক্ষয়িত হলেন- তাঁদের রচনা যে এমন সমতলরকম সদৃশ, এমন আশুক্লান্ত, পাণ্ডুর, মৃদুল, কবিতে-কবিতে ভেদচিহ্ন যে এত স্পষ্ট, একমাত্র সত্যেন্দ্র দত্ত ছাড়া কাউকেই যে আলাদা করে চেনা যায় না- আর সত্যেন্দ্র দত্তও যে শেষ পর্যন্ত শুধু ‘ছন্দোরাজ’ই হয়ে থাকলেন- এর কারণ, আমি বলতে চাই, শুধুই ব্যক্তিগত নয়, বহুলাংশে ঐতিহাসিক।’

 বুদ্ধদেব বসুর ‘মর্মবাণী’ সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘তন্বী’ কাব্যগ্রন্থদ্বয়ে, অমিয় চক্রবর্তীর প্রাথমিক কাব্যচর্চায় রবীন্দ্রানুসরণ খুবই স্পষ্ট। প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘প্রথমা’ কাব্যের কবিতায় রাবীন্দ্রিক মানবতাবাদেরই নতুন বিন্যাস। এমনকি জীবনানন্দের ‘ঝরাপালক’ কাব্যগ্রন্থের কোনো কোনো কবিতাতেও রবীন্দ্রনাথের প্রভাব লক্ষণীয়।’

ছোটগল্পের ভাষা দিয়েই রবীন্দ্রনাথ সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছেন তাঁর পরবর্তী লেখকদের উপর। বাংলা ছোটগল্পের ভাষা তো রবীন্দ্রনাথের আপন হাতের সৃষ্টি। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যায় তাঁর এই ভাষ্য: ‘গদ্যের ভাষা গড়তে হয়েছে আমার গল্প-প্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে। মোপাসাঁর মতো যে সব বিদেশী লেখকের কথা তোমরা প্রায়ই বল, তাঁরা তৈরি ভাষা পেয়েছিলেন। লিখতে লিখতে ভাষা গড়তে লিখতে লিখতে ভাষা গড়তে হলে তাঁদের কি দশা হত জানি নে।’



 নিজ সাধনা দিয়ে রবীন্দ্রনাথ নির্মাণ করলেন ছোটগল্পের ভাষা, সামান্য ব্যতিক্রম বাদে, সে ভাষাতেই এখনো লেখা হচ্ছে বাংলা ছোটগল্প। বিষয়াংশ নির্বাচন, কিংবা দৃষ্টিকোণ, পরিচর্যা, প্রকরণ-প্রকৌশল- যে কোনো ক্ষেত্রেই দেখি, ছোটগাল্পিক রবীন্দ্রনাথ অলক্ষ্যে এসে হাজির হন উত্তরকালীন বাঙালি গল্পকথকদের কাছে

উপন্যাসের ক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথের উত্তরপ্রভাব বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। আধুনিক উপন্যাসে মানব-মনস্তত্ত্ব। বিশ্লেষণের যে ধারা, তার সূত্রপাত ঘটে রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’তে। রাজনীতি সচেতনতা, প্রাগ্রসর প্রেমচেতনা, আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট-  বিশ্বযুদ্ধোত্তর আধুনিক উপন্যাসের এসব চারিত্রিক উৎস হিসেবে আমরা বিশেষভাবে স্মরণ করতে পারি রবীন্দ্রনাথের ‘চার অধ্যায়’, ‘গোরা’, ‘যোগাযোগ’, ‘শেষের কবিতা’ প্রভৃতি উপন্যাস। মনো-বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের পাশাপাশি দেশ ও সমাজ সম্পর্কে এসব উপন্যাসে যে চেতনা প্রকাশ পেয়েছে, পরবর্তী লেখকেরা তা থেকে পৌনঃপুনিক গ্রহণ করেছেন তাদের রচনার রসদ। উপন্যাসের বক্তব্যের পাশাপাশি আঙ্গিক স্বাতন্ত্র্যের প্রেক্ষাপটে ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের কথা বিশেষভাবে বলতে হয়। এই উপন্যাসে চারজন মানুষের স্বতন্ত্র বয়ানকে যেভাবে একাত্ম করে নেওয়া হয়েছে, উত্তরকালীন ঔপন্যাসিকেরা মানব-প্রতিবেদন নির্মাণে, আখ্যান সৃষ্টিতে সেখান থেকে অবিরাম চয়ন করেছেন শিল্পরস। আধুনিক মানুষের অতলান্ত শূন্যতার শিল্প হিসেবে ‘দুইবোন’ উত্তরকালে বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায় নতুন নতুন রূপে পরিগ্রহণ করেছে।

 

ঔপন্যাসিক প্রতিবেদনের ভাষার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের উত্তরপ্রভাব সাগরের মতো বিশাল, আকাশের মতো সীমাহীন। বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষারীতি অতিক্রম করে রবীন্দ্রনাথ উপন্যাসের যে ভাষাবৈশিষ্ট্য নির্মাণ করলেন, শতাব্দীব্যাপী তা-ই অবলীলায় অনুসৃত হয়েছে। ব্যতিক্রম যে নেই, তা নয়। ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের ভাষা সাধু, কিন্তু সাধুরীতির অন্তরালে এখানে আছে কথ্যভাষার লঘুতা এবং প্রবহমানতা। রবীন্দ্রনাথের অন্ত্যপর্বের অধিকাংশ উপন্যাসই আত্মকথনমূলক বা নিজ-জবানীতে লেখা। উত্তম-পুরুষেরা নিজ জবানীতে কোনো কিছু বর্ণনা করতে গেলে স্বভাবতই প্রাধান্য পায় কথ্যরীতি। উত্তরজীবনে চলিত ভাষাতে উপন্যাস রচনার বাহন করার পরীক্ষা রবীন্দ্রনাথ যেন সম্পন্ন করলেন ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসে।  সাধুগদ্যের মাঝেই এখানে তিনি সঞ্চার করেছেন চলিতের দীপ্তি আর ঝলকানি আর প্রবহমানতা। উপন্যাস যে বর্ণনামূলক ডিসকোর্স, ‘চতুরঙ্গ’র ভাষা আর বর্ণনায় তা সম্যকরূপে উপলব্ধিযোগ্য। রবীন্দ্রনাথের সার্বভৌমত্ব এখানে যে, উত্তরকালীন ঔপন্যাসিক প্রতিবেদন কীভাবে লিখতে হবে, সে কথাও তিনি যেন অলক্ষ্যে জানিয়ে দেন তাঁর পরবর্তীদের। এ প্রসঙ্গে ‘শেষের কবিতা’র ভাষার কথাও বলতে হয়। বস্তুত, প্রেমের উপন্যাসের ভাষার আদর্শ রূপটাই যেন ‘শেষের কবিতা’। এ উপন্যাসের ভাষাদর্শ কীভাবে উত্তরকালীনদের মোহগ্রস্ত করে রেখেছে, বুদ্ধদেব বসুর বয়ানে তা ধরা পড়েছে এভাবে:

সে সময়ে যেটা আমাদের মনে সবচেয়ে চমক লাগিয়েছিল সেটা ‘শেষের কবিতা’র ভাষা। অমন গতিশীল, অমন দ্যুতিময় ভাষা বাংলা সাহিত্যে ইতিপূর্বে আমরা পড়িনি। ... বাংলা এত সাবলীল হতে পারে, তাকে যে ইচ্ছে মতো বাঁকানো, হেলানো, দোমড়ানো, মোচড়ানো সম্ভব, আলো-ছায়ার এত সূক্ষ্ম স্তর তাতে ধরা পড়ে, খেলা করে ছন্দের এত বৈচিত্র্য, তা আমরা এর আগে ভাবতেও পারি নি। তাই এই বইটি হাতে পেয়ে যদি আমাদের মনের অবস্থা চ্যাপম্যানের হোমার পাঠান্তে কীটসের মতো হয়ে থাকে, তাতে অবাক হবার কিছু নেই।’

 

নাটকের ক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথের উত্তরপ্রভাব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । ‘নাট্য-আঙ্গিক সৃজনেও রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা ব্যাপক। বিসর্জন’ নাটকের প্রাগ্রসন্ত ধর্মবোধ, মুক্তধারার গতিশীলতা, ‘রক্তকরবী’-র রাজনীতি সচেতনতা বাংলা নাটককে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। একালের নাটকে যে প্রাগ্রসর সমাজ-সচেতনতা, তার সূত্রপাত ঘটেছে ‘রক্তকরবী’তে- একথা বললে কী কোনো অত্যুক্তি হবে? ঔপনিবেশিক নাট্যফর্ম ভেঙে রবীন্দ্রনাথ সচেতনভাবে আশ্রয় করেছিলেন প্রাত্যহিক নাট্যরীতি। তাঁর নাটকে সঙ্গীত, নৃত্য এবং সংলাপের ত্রিমাত্রিক ঐক্য বাংলা লোকনাটকের কথাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। এ কালে যে বর্ণনামূলক নাটকের কথা বলা হয়, তার প্রাথমিক প্রয়াস কি ‘রক্তকরবী’ নয়? নাট্যসংলাপের ক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথ আছেন সদাজাগ্রত। নাটক যে মঞ্চের শিল্প, মঞ্চই যে তার পরম গন্তব্য- সেক্ষেত্রেও আমাদের স্মরণ করতে হবে রবীন্দ্রনাথকে। মঞ্চকলা নির্মাণেও তিনি প্রভাবিত করেন তাঁর উত্তরকালীনদের। প্রসঙ্গত আমরা স্মরণ করব ‘তপতী’ নাটকের ভূমিকা, স্মরণ করব ‘রঙ্গমঞ্চ’ প্রবন্ধ।

 এরিস্টটলীয় রীতিতে নাটক লিখেছেন তিনি, আবার তিনিই ভেঙে দিয়েছেন সনাতন সব নাট্যআঙ্গিক। লিখেছেন একাঙ্ক নাটক, এক চরিত্রের নাটক, লিখেছেন কাব্যনাট্য, নাট্যকাব্য। উত্তরকালীন নাট্যকারদের পথটাকে খুব কঠিন করে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, নাকি সহজ? তাঁর প্রভাবকে অতিক্রম করা কি একালের এবং অনাগত কালের কোনো নাট্যকারের পক্ষে সম্ভব?

বিষয়াংশ এবং ভাষারীতি- উভয় দৃষ্টিকোণে রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ সাহিত্যও উত্তরকালীনদের কাছে বিস্তার করেছে মোহনীয় প্রভাব। একথা অস্বীকারের কোনো উপায় নেই, তিনিই বাংলা প্রবন্ধের জনয়িতা। তাঁর প্রবন্ধ তত্ত্বভারমুক্ত, পাঠকের সঙ্গে তাঁর ঘটে সেখানে সহজ আত্মীয়তা। মিলনের বাসনাই রবীন্দ্র-প্রবন্ধসাহিত্যের মৌল বাণী। প্রবন্ধসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ যে গদ্য নির্মাণ করেছেন, তার প্রধান বৈশিষ্ট্য উপযোগিতা, শিল্পিতা ও যুক্তিবাদিতা। সন্দেহ নেই, এসব বৈশিষ্ট্য পরবর্তী লেখকদের কাজে সঞ্চার করেছে অনেকান্ত সহযোগ।

 তথ্য ঋণ-

১ .বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের উত্তরপ্রভাব-  বিশ্বজিৎ ঘোষ


২. উইকিপিডিয়া


৩. ইন্টারনেট



 
 
 

コメント


Subscribe Form

Thanks for submitting!

©2021 by Agantuk Potrika.

bottom of page