top of page
Search

প্রবন্ধে তপন তরফদার - ১


বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় ও বোধোদয়


তপন তরফদার


আমারা শুরু করি কিন্তু শেষ করিনা। আলোচনা করি কিন্তু হৃদয়ে আনিনা। বাংলা ভাষার শুরু বর্ণপরিচয় দিয়ে আর বোধোদয় শব্দের গুরুত্ব অপরিসীম। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১২৯ বছর আগে ইশ্বর প্রাপ্তি হয়ে ও তার “বোধোদয়” আজও প্রণিধান। (১৮৯১খৃষ্টাব্দের ২৯শে জুলাই কলকাতার বাদুড় বাগানের বাসভবনে লিভারের ক্যানসারে মৃত্যুবরণ করেন) তার প্রজ্জ্বলিত মশালের অনির্বাণ শিখা অমল রবির কিরণ হয়ে আমাদের পথ প্রদর্শক।তার সৃষ্টি গ্রন্থ আজও “মানব জাতির বোধোদয় জাগায়।“

বিদ্যাসাগরের উদ্দেশ্যে স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন, “তাঁহার পূর্বে কেহই এরূপ সুমধুর বাংলা গদ্য লিখিতে পারে নাই, এবং তাঁহার পরেও কেহ পারে নাই।“ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম অগ্রণী অধ্যাপক অসিত কুমার বন্দোপাধ্যায় বলেছেন, ‘তিনি সরল তরল নোটবুক/প্রশ্নোত্তরমালা লিখে শিক্ষার্থীদের সর্বনাশ করেননি। যিনি অক্লেশে মণিহর্ষ্য নির্মাণ করতে পারতেন, তিনি তাঁর সমস্ত দক্ষতা খড়ো-ছাওয়া বাংলাঘর তৈরিতে মনোনিবেশ করেছেন। কেন? আসলে বিদ্যাসাগর শিশু-বালক-কিশোর পাঠ্য অনেকগুলি পুস্তক লিখে বিদ্যাসাগর জ্ঞানঞ্জনশলাকা দিয়ে বাঙালি জাতিকে চক্ষুষ্মান করতে চেয়েছেন।“ ইংরেজি সাহিত্যের আদর্শে যতি চিহ্ন ব্যবহার করেন। ইংরেজদের শাসনের ফলস্বরুপ বাংলা গদ্যের বিস্তার শুরু হল। সেই সময়ে গদ্য প্রধানতঃ ভাব প্রকাশক, বাচনিক (communicative )ছিল। বিদ্যাসাগর গদ্যের মাধ্যমে অর্ন্তজীবনকে নান্দনিক aesthetic করে তোলেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যভাষার উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে সুবিভক্ত, সুবিনস্ত, সুপরিচ্ছন্ন ও সুসংহত করিয়া তাহাকে সহজ গতি ও কর্মকুশলতা দান করিয়াছিলেন।‘ ভাষাচার্য্য সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন –‘তাঁহার এই সংস্কারকামী মনের বিশেষ পরিচয় পাওয়া যায়।‘ ১৮২৯ সালে দরিদ্র ইশ্বর সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হন। সেই সময় ভারত পথিক রামমোহন সাধারণ মানুষের শিক্ষার জন্য সচেষ্ট। তখন (Age of reasons ) যুক্তির যুগ, (Rights of man) মানুষের অধিকার আন্দোলন শুরু হয়েছে। বিদ্যাসাগর এই সামাজিক আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। ইশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় ১৮২০ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর হুগলী জেলার বীরসিংহ গ্রামে জন্ম এই দেশের এক পরম সৌভাগা। (তখন বীরসিংহ গ্রাম হুগলী জেলার অর্ন্তগত ছিল) ওনার বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা করলে অনেক সাগর তৈরি করতে হবে। শিক্ষাজীবনে হিন্দু’ল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মাত্র উনিশ বছর বয়সে ১৮৩৯সালে বিদ্যাসাগর উপাধি পান। আমি শুধু ওনার শিক্ষার চিন্তা-ধারা সম্পর্কে স্বল্প পরিসরে কয়েকটি কথা উল্লেখ করতে চাই। তিনি বিভিন্ন বিষয়ে বই লিখেছেন। লেখাপড়া শেখার জন্য অন্তত এগারটি বই লিখেছেন। বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ বর্ণপরিচয় দ্বিতীয় ভাগ, বোধোদয়, কথামালা ,নীতিবোধ ,চরিতাবলী, জীবনচরিত, বাঙ্গালার ইতিহাস, আখ্যানমঞ্জরী (তিনটি ভাগ)।

বর্ণপরিচয়ের গভীরে গিয়ে কয়েকটি কথা মনে রাখতে হবে। বর্ণপরিচয় ১৮৮৫ সালে রচনা করেন। তখন কিন্তু মনোবিজ্ঞান বা শিশু পাঠ্যপুস্তকে বিশেষ কোনো শিক্ষা বিজ্ঞান ছিল না। আজকের শিক্ষা বিজ্ঞান অনুসারে শিক্ষাকে অবশ্যই হতে হবে শিক্ষা গ্রহণ ও শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক (learning and learner oriented )। কখোনই ‘শিক্ষাদান ও শিক্ষাকেন্দ্রিক (teaching and teacher oriented) নয়। শিশু শিক্ষার্থীদের শিক্ষার বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করে নিজেই বিশেষ উদ্যোগী হয়ে রচনা করেন বর্ণপরিচয়।

বর্ণপরিচয়ের বিশেষ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য আছে। তিনি বর্ণমালাকে, বিঞ্জানকে অনুসরণ করেই সংস্কার করেছিলেন। স্বরবর্ণ মালা থেকে দীর্ঘ ঋ এবং দীর্ঘ , ৯(লি), অনুস্বর (ং) এবং বিসর্গ( ঃ) বাদ দেন। বারোটি স্বরবর্ণ হয়। আবার ব্যঞ্জন বর্ণমালায় অনুস্বর (ং) বিসর্গ (ঃ) এবং চন্দ্রবিন্দু (ঁ) অন্তর্ভুক্ত করেন। ড়,ঢ়,য়, কে পৃথক বর্ণের মর্যাদা দেন। ক্ষ কে বাদ দেন। ত- এর দ্বিতীয় কলেবর খন্ড-ত (ৎ)যুক্ত করেন। বর্ণ গুলি মনে রাখতে সহজ ছড়ায় বুঝিয়েছেন। পরের ধাপে মনোবিজ্ঞানীর মতো উনি অক্ষর ধরে শব্দপাঠ এর প্রচলন করেন। শব্দ যদিও বোদ্ধার কাছে সর্বদা অর্থবহ শব্দ। কিন্তু শিশুর কাছে অনেক পরিমাণে ধ্বনি বা ধ্বনির সমাহার। বর্ণমালা তার কাছে পৌঁছাচ্ছে ধ্বনি হিসাবে। স্বরধ্বনি ও ব্যঞ্জনধ্বনি।


(ক্রমশ...)

71 views0 comments
bottom of page