top of page
Search

বিশেষ সংখ্যা ।। ভয় ভৌতিকে ।। প্রদীপ দালাল


তারা স্বপ্নে আসে


প্রদীপ দালাল 



আমার ঠিক কী হয়েছে, আমি জানি না, তবে কিছুদিন  ধরে রাতে ঠিকঠাক ঘুমতে পারছি না; শুধুই মনে হচ্ছে, চোখ বুজলেই আমি ওদের দেখতে পাব! কিন্তু এমনভাবে তো আর চলতে পারে না।চোখের কোলে কালি দেখা দিতে শুরু করেছে,অথচ কাউকে এই বিষয়ে কিছু জানাতেও পারছি না।আর কিই বা জানাব,নিজের কাছেই তো পুরো বিষয়টা কেমন গোলমেলে এবং রহস্যময়। এই তো কিছুদিন আগেই সবকিছু কেমন স্বাভাবিক ছিল ; আমি কলেজ স্ট্রিট গিয়েছিলাম কিছু দরকারি বই কিনতে। দেখেশুনে নিলে, সস্তায় বেশ ভালো ভালো বই পাওয়া যায় সেখানে __ এই কথাটা বহুজনের মুখ থেকে শুনে আমারও কেমন ঝোঁক চেপে যায় মনে, তাই আমিও চলে গেলাম সস্তায় বই কিনব বলে, কিন্তু তখন কে জানত,সস্তা জিনিসের এতো ভারী দাম চুকাতে হবে। 



বি.এ. থার্ড ইয়ারে পড়ি। হবি বলতে, ক্রিকেট খেলা,তবে পড়াশোনার চাপে খেলার সময় বড়ো একটা মেলে না,তাই, দেখেই মন ভোলাই। আর একটা জিনিস যা আমার খুব প্রিয় তা হল, রাতে হাড় হীম করা ভূতের গল্প পড়া।সেই নেশায় কিছুটা ছুটে আসা কলেজ স্ট্রিটের পুরনো বইয়ের দোকানগুলোতে;শুনেছি, এখানে বহু শতাব্দী পুরনো বইও না কি মিলে যায়, তাই আমিও চলে এলাম।



"দাদা, ওই বইটা একটু দেখাবেন," লাল লেদারে জড়ানো জীর্ণ একটা বইয়ের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললাম। 


"কোনটা ঠিক বুঝলাম না, " বললেন দোকানের মালিক। 


"ওই যে, আপনার ডানদিকে,লাল বইটা।"


বইটার দিকে তাকাতে ভদ্রলোকের মুখের অভিব্যক্তি কেমন হঠাৎ পালটে গেল।


"দাদা, এই বইটা তো বিক্রি করতে পারব না,"কেমন কাচুমাচু করে কথাটা বললেন উনি।


" কেন? তা বিক্রি করতে পারবেন না তো রেখেছেন কেন?"


"কী বলি বলুন তো,আসলে গতকালই একটা ছেলে এই বইটা আমায় দিয়ে যায়, আর বলে,বইটা যেন আমি কাউকে বিক্রি না করি,"কথাগুলো বলে উনি ওই বইটার দিকে কেমন সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকালেন।


আমার আবার কোথাও একটু রহস্যের গন্ধ পেলেই তা সম্পূর্ণ উদঘাটন না করা পর্যন্ত ক্ষান্ত হই না।তাই আমিও নাছোড়বান্দা হয়ে লেগে পড়লাম বিষয়টার গোড়া পর্যন্ত পৌঁছাতে,কিন্তু তদন্ত শুরু হওয়ার আগেই যবনিকা টেনে দিলেন ওই দোকানদার এই কথা বলে যে উনি বইয়ের মালিককে চেনেন না এবং জানেনও না যে উনি কোথা থেকে এসেছিলেন কারণ কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই না কি উনি হাওয়া হয়ে গিয়েছিলেন। 



" আমি এই বইয়ের মালিক না হয়ে আপনাকে বিক্রি করি কী করে, বলুন?ভাবছি, ছেলেটা যদি আজ কালের মধ্যে না আসে, তো এই বইটা কোনো লাইব্রেরীতে দিয়ে দেব,কী বলেন?"



আমি তখন অন্যমনস্ক হয়ে অন্য কিছু ভাবছিলাম,হঠাৎ দোকানদারের প্রশ্ন করাতে আমার হূঁশ ফিরল।ভদ্রলোক বললেন,"আচ্ছা, আপনিই না হয় এই বইটা কোনো লাইব্রেরীতে দিয়ে দেবেন।আমার মনে হয় না যে ছেলেটা আর আসবে।"


আমার এমনিতেও ওই বইটার প্রতি প্রবল কৌতূহল জেগে উঠেছিল, তাই সুযোগ পাওয়াই আর না বললাম না।মনে মনে ঠিক করলাম,আগে কিছুদিন বইটাকে নিজের কাছে রেখে পড়ব তারপর লাইব্রেরীতে না হয় গিয়ে জানব যে তারা এই বইটাকে নেবে কি না।না নিলে, নিজের কাছেই রেখে দেব।



এমন একটা রহস্যজনক জিনিস হাতে পেয়ে মনটা বেশ উৎফুল্ল ছিল।রাতে খাওয়ার পর বই পড়ার নেশা আমার বরাবরের,আবার তার উপর সদ্য আনা পুরনো বইয়ে চাপা অজানা জগতের হাতছানিকে উপেক্ষা করে কে?ব্যস, বসে পড়লাম বই নিয়ে।প্রথমে, বইটাকে নাড়াচাড়া করে দেখলাম, বইটা আর পাঁচটা সাধারণ বইয়ের মতো নয়,দেখে মনে হয় যেন বইটাকে বহুবার বাঁধানো হয়েছে। না জানি, কত যুগ যুগ ধরে কত হাত ঘুরে আমার হাতে এসে পৌঁছেছে।বইয়ের পাতাগুলো একটা একটা করে চোখের সামনে মেলে ধরতে আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম ; প্রতিটা পাতা বাংলা হরফে নিখুঁত হাতের লেখায় সাজানো,ক্যালিগ্রাফি বললে, একদমই বেশি বলা হবে না। লেখাগুলোকে পড়ার চেষ্টা করতে বুঝলাম,একেবারে পাতি বাংলা ভাষায় লেখা,তাই বুঝতে কোনোরকম অসুবিধা হল না, কিন্তু এসব কী লেখা! ভেবেছিলাম, প্রাচীন পুথি, নিশ্চয় এর মধ্যে প্রাচীন ইতিহাস কিংবা ঋষি মুনিদের নানা তত্ত্ব নিয়ে আলোচনার কথা লেখা থাকবে, কিন্তু যা সব বিবরণ দেওয়া আছে তা পড়লে গা গুলিয়ে ওঠে; যদি কেবল লেখার বর্ণনার দ্বারা কাউকে পৈশাচিক কর্মকাণ্ডের সাথে পরিচয় করাতে হয়, তবে এই বইটি হবে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এমন সব নারকীয় ঘটনার কথা লেখা আছে যা একটা মানুষকে গ্রীষ্মের গরমেও শীতের কাঁপুনির অনুভব করায়।আমি আর পড়তে না পেরে বইটাকে টেবিলের ওপর রেখে শুয়ে পড়লাম।



রাত, জানি না, তখন কটা, প্রচণ্ড তেষ্টায় গলা শুকিয়ে যাওয়ায় ঘুম ভেঙে যায়। চোখ খুলতেই দেখি ঘর একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার, চারিদিক নিস্তব্ধতা,বাইরে  ঝিঁঝিপোকার একঘেয়ে ডাকে সেই নিস্তব্ধতা যেন আরও বেড়ে উঠেছে । মাথার উপর কিছু মিটমিট করে জ্বলতে দেখে আরও ভালো করে সেই দিকে চেয়ে থাকি, প্রথমে জোনাকির আলো বলে ভুল হলেও তারপর বুঝি যে ওই গুলো আসলে তারা,কিন্তু ঘরের মধ্যে থেকে তারা দেখব কী করে?খানিকক্ষণ পর অন্ধকারে চোখ সয়ে যাওয়াতে ব্যাপারটা পরিস্কার হয় আমার কাছে।আমি এখন যেখানে আছি সেই জায়গায় পৌঁছালাম কী করে তা আমি জানি না, কিন্তু সেই কথা মনে মনে ভাবায় আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে, আমি চারদিক ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারি, জায়গাটা আসলে একটা জঙ্গল। হঠাৎ গায়ের কাছ দিয়ে একটা ছোটো প্রাণীকে পেছনে ঝোপের আড়ালে চলে যেতে শুনে ওই দিকে তাকায়,আর তাকাতেই একটা আশ্চর্য জিনিস চোখে পড়ে; আমি যেখানে আছি সেখান থেকে প্রায় বিশ ত্রিশ হাত দূরে খানিকটা ফাঁকা জায়গায় কিছু লোককে আগুনের চারদিকে ঘিরে কিছু একটা করতে দেখি।


"শীতকাল নয় যে আগুন পোহাবে, তাহলে কি এতো রাতে এখানে বনভোজন করছে? তাই বা কী করে হয়!" মনে মনে আমি এসব ভাবতে থাকি।


গাছপালার আড়ালে স্পষ্ট দেখাও যাচ্ছে না জায়গাটাকে। আমি ওইদিক পানে খানিকটা এগিয়ে যায়, যদি তারা আমায় কোনোভাবে সাহায্য করতে পারে। দূর থেকে তাদেরই মধ্যে একজনের হাতে কী যেন একটা ধরে থাকতে দেখি। দূরত্ব কমার কারণে এবং আলোর কিছুটা কাছে আসাতে দেখি সেখান থেকে টুপটুপ করে রক্ত পড়ছে এবং তাতে সারা মাটি লাল হয়ে আছে। আরেকটু ভালো করে লক্ষ্য করাই যেটা দেখি, তা দেখে আমার শিরদাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডা স্রোত নেমে যায় ; মানুষের একটা কাটা হাত!নিজের চোখকে প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না,এ কী দেখছি আমি! তারপর এদিক ওদিক চোখ ঘোরাতে যেটা দেখি তাতে আমার শরীরের রক্ত আতঙ্কে জমাট বেঁধে যায়,শরীরের সমস্ত রোম খাড়া হয়ে যায়, হৃদপিণ্ডটা এতো জোরে জোরে স্পন্দিত হতে লাগে যে মনে হয় যেন কেউ ভেতর থেকে হাতুড়ি পেটাচ্ছে ; তাদেরই কাছে একটা মানুষের ক্ষতবিক্ষত কাটা ছেঁড়া দেহ পড়ে আছে, যার হাত, পা, মাথা কোনোকিছুই আর নিজের জায়গায় নেই। 


লোকগুলোর প্রত্যেকের পরনে গাঢ় লাল ধুতি, কপালে কুমকুমের তিলক আর গলায় হাড়ের মালা ; উফ!কী বীভৎস সে দৃশ্য! লোকগুলো এরপরে জোরে জোরে মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে যে যার হাতে মৃতদেহের কাটা অংশ গুলো তুলে নিয়ে আগুনের ওপর উঁচু করে তুলে ধরে আর সেখান থেকে বেরিয়ে আসা রক্ত আগুনে পড়তে থাকে, দেখে মনে হয়, তারা যেন কোনো পৈশাচিক যজ্ঞ করছে। এরপর তাদেরকে যে পৈশাচিক কাণ্ড ঘটাতে দেখি তাতে আমার স্নায়ু মণ্ডলীর ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখা কঠিন হয়ে পড়ে; লোকগুলো এবার হাতে ধরে থাকা সেই কাটা অংশ গুলোকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে শুরু করে। ওই দৃশ্য দেখে আতঙ্কে আমার মুখ থেকে একটা অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে আসে আর তাদেরই মধ্যে একজনের নজর আমার ওপর পড়ে। আমার পা তখন থরথর করে কাঁপছে, লোকটা চোখের ইশারায় সকলের দৃষ্টি আমার দিকে আকর্ষণ করতেই আমি সঙ্গে সঙ্গে প্রাণপণে ছুটতে শুরু করি। কোথায় পা ফেলছি,কোন দিকে ছুটছি, কোনোকিছুই তখন আর মাথায় নেই , কেবল ওই নরমাংস খাদকদের থেকে প্রাণ বাঁচাতে হবে, এই চিন্তায় কেবল ছুটে চলেছি আর মাঝে মাঝে পিছন ফিরে দেখছি।  ওদের উন্মাদ নেকড়েবাঘের মতো শিকার ধরবার তীব্র লালসায় আমার পিছনে ধেয়ে আসতে দেখে আমি বুঝতেই পারিনি যে আমার সামনে কখন একটা গাছ এসে পড়ে, গাছে সজোরে মাথায় ধাক্কা লাগায় আমি মাটিতে ছিটকে পড়ি। "আ..." বলে চিৎকার করে মাথা তুলে দেখি আমি খাট থেকে ছিটকে মেঝেতে পড়ে গিয়েছি। 



এরপর দিন কতক প্রতিরাতেই এমন সব ভয়ানক স্বপ্ন দেখে, না জানি, কতবার মেঝেতে আছড়ে পড়েছি।প্রতিটা স্বপ্নেয় একটা জিনিসের অদ্ভুত রকম মিল পেয়ে আমি অবাক হই , প্রতিটা স্বপ্নই ছিল ক্যানিবালিজিম অর্থাৎ নরমাংসভক্ষণ প্রথা নিয়ে। এরপর থেকেই ওই বইটাকে কেমন ভয় করতে শুরু করে, বইটাতে ওই নরমাংস খাদকদের ব্যাপারে পড়ার পর থেকেই আমি ওই উদ্ভট স্বপ্ন দেখা শুরু করি। আরও একটা পরিবর্তন আমার নিজের মধ্যে লক্ষ্য করি : আমি বরাবর মাংস খেতে অপছন্দ করতাম,  তবে ইদানীং মাংসের প্রতি অহেতুক ঝোঁক দেখে আমার পরিবারের লোক খুশি হলেও আমার বেশ ভয় লাগতে শুরু করে, খাসি মুরগী না হয় ঠিক আছে, কিন্তু ঝোঁকটা ওই পর্যন্ত সীমিত থাকলে হয়! আমি আর দেরি না করে বইটাকে নিয়ে লাইব্রেরীতে যায়। সেখানে কথাবার্তা বলে যেটা দাঁড়ায়, তা হল, তারা এমন অজ্ঞাতনামা লেখকের বই নিজেদের লাইব্রেরীতে রাখতে প্রস্তুত নন। অগত্যা আমায় বইটা বাড়ি ফিরিয়ে আনতে হল। বইটাকে নিজের কাছে রাখতেও মন চাইছে না অথচ কোথাও ফেলে দিতেও মন সাঁই  দিচ্ছে না, যতই হোক, বই তো। শেষমেশ আমি স্থির করি, বইটাকে যার কাছ থেকে এনেছি, তাকেই ফেরত দিয়ে দেব,কী দরকার এই আপদকে ঘরে রাখার? 



কলেজ স্ট্রিট পৌঁছে সে আর এক ঝামেলা ; বিচুলির গাদায় সূঁচ খুঁজে পেলেও এখানে এই রাশি রাশি বইয়ের দোকানের মধ্যে থেকে কোন দোকান থেকে আমি এই বইটা সেদিন সংগ্রহ করেছিলাম তা খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব। অনেক খাটাখাটুনি করে যখন হাল প্রায় ছেড়েই দিয়েছি তখন একটা গলির বাঁকে নজর যেতেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ি।


 "সেই দোকানদারটা না?"মনে মনে ভাবি, " হ্যাঁ, ওই হবে হয়তো , কিন্তু ওখানে ও কী করছে?"


কাছে গিয়ে দাঁড়াতে লোকটা হকচকিয়ে যায়। 


"কী দাদা, আজ দোকান খোলেন নি, আমার তো আপনাকে সারাদিন ধরে খুঁজে খুঁজে নাজেহাল অবস্থা। "


"কেন, আমায় আপনি কেন খুঁজছেন?" কাঁধের বস্তাটা নীচে নামিয়ে লোকটা কেমন বিরক্তি ভরা দৃষ্টিতে আমার দিকে প্রশ্নটা ছোঁড়ে।


"আ রে,  ভুলে গেলেন, এই যে বইটা, " ব্যাগ থেকে বইটা বার করে বলি,"কিছুদিন আগে আপনি আমায় দিয়েছিলেন লাইব্রেরীতে দিয়ে দিতে, কিন্তু কেউ এই বই নিতে চাইছে না, তাই আমি ফেরত দিতে এসেছি।"


বইটাকে দেখে লোকটার মুখের ভাব হঠাৎ বদলে যায়, সেটা যে ভয়ের তা স্পষ্ট বোঝা যায়। 


"আমি কোনো বই কাউকে দিই নি, আমার অনেক কাজ আছে, আমি যায়, " বলে বস্তাটা আবার পিঠের উপর তুলে নিয়ে পালিয়ে যাবে আমি সঙ্গে সঙ্গে তাকে আটকায়। 


"কী ব্যাপার, আপনি হঠাৎ এমনভাবে পালিয়ে যাচ্ছেন কেন? বইটাকে নিয়ে কী রহস্য আছে, আমায় বলুন, না হলে, আমি পুলিশকে ডাকব।"


লোকটা আমার কথায় এবার হেসে উঠে বলে,"পুলিশের কম্ম নয়, দাদাবাবু, এ জাদুবিদ্যা, কালা জাদু, পুলিশ কিস্সু করতে পারবে না।"


আমি তখন একটা ঢোক গিলে বলি,"তার মানে তুমি এই বইটার ব্যাপারে সব মিথ্যে বলেছিলে! এই বইটা আসলে তোমার ছিল।তুমি আমায় কেন এই বইটা দিলে? আমি তো তোমার কোনো ক্ষতি করিনি।"


"এই বই কাউকে দেওয়া যায় না,যখন কেউ স্বেচ্ছায় এই বই নেয় তখনই কেবল এই বইয়ের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। অল্পদিনে কালা জাদু শিখব বলে এক তিব্বতি বাঙালি তন্ত্র সাধকের কাছ থেকে আমি এই বইটা চুরি করি।কীভাবে, জানি না, ওই সাধক আমার বদ মতলবের কথা জানতে পেরেছিল, হয়তো মন পড়তে পারে, তাই আসল বই লুকিয়ে রেখে আমায় শায়েস্তা করতে এই বইটা রেখে দিয়েছিল।"


"কিন্তু এই বই থেকে মুক্তি পাবার উপায় তুমি কীভাবে জানলে?" 


চোখের জল মুছতে মুছতে লোকটা বলে,"আমি নিজেই ওই তন্ত্র সাধকের কাছে গিয়েছিলাম ক্ষমা চাইতে।ওইসব ভয়ংকর স্বপ্নের কারণে আমার বেঁচে থাকাটাই দুর্বিসহ হয়ে উঠেছিল। তখন উনিই আমায় এর মুক্তির পথ বলে দেন। তাই সেই থেকে রোজ এক বন্ধুর বইয়ের দোকানে নিয়মিত বসতে শুরু করি , জানতাম কেউ না কেউ ওই পুরোনো বইটা নিতে চাইবে,তবে আমায় বইটা বিক্রি করলে চলত না,তাই ওই গল্পটা ফাঁদি।"


আমার তখন নিজের ওপর এতো রাগ হয় যে মনে হয় নিজের গালেই চর মারি। এইজন্যই বলে, অহেতুক কৌতূহলী হওয়া ভালো নয়।এই সব ভাবতে ভাবতে লোকটার হাতে ধরে থাকা বস্তার দিকে নজর যেতে দেখি সেখানে এক জায়গায় রক্তের দাগ লেগে।


"আপনার এই বস্তায় কী আছে? " প্রশ্নটা করায় লোকটা কেমন সতর্ক হয়ে গিয়ে বস্তাটাকে পিছনে সরিয়ে রেখে বলে, "ও কিছু না,দাদাবাবু, আমার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র,"কথাটা বলে আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে জরিপ করে বলে," খুব খিদে পাই, জানেন দাদাবাবু, অথচ তেমন ভালো কিছু জোটে না,"?


কথাগুলো বলার সময় আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে, সেই দৃষ্টিতে এখন লালসার ছাপ স্পষ্ট বোঝা যায়।আমার তাতে ভীষণ অস্বস্তি হয়।তারপর লোকটা বলে,"আর অল্প কিছু দূরত্বেই আমার বাড়ি,বুঝতেই পারছেন, একা এই ভারী বস্তা বয়ে নিয়ে যেতে কতটা কষ্ট হয়,তাই বলছি,দাদাবাবু, আপনি যদি একটু সাহায্য করেন তো খুব ভালো হয়।"


একবার নির্জন রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে নিয়ে ভাবি,এই জায়গায় যদি আমায় কেও মেরেও ফেলে কাকা পক্ষীও টের পাবে না, চারদিকে কেবল উঁচু উঁচু পুরোনো অট্টালিকা আর কিছু অশ্বত্থ গাছ, রাস্তায় একটা কুকুর পর্যন্ত নেই।লোকটা যেভাবে আমার দিকে চেয়ে আছে তাতে তার মতলবটা ঠিক ভালো ঠেকছে না,কে জানে আমাকেই না শেষমেশ নিজের খোরাক বানায়।এই নির্জন জায়গায় এই লোকটার সাথে আর বেশিক্ষণ থাকাটা নিরাপদ না দেখে বইটা লোকটার গায়ে ছুঁড়ে ফেলে সেখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে আসি।পালানোর সময় পিছন থেকে ওই লোকটার অট্টহাসি শোনা যায়," হা...হা...হা..."



ওই ঘটনার কয়েকমাস বাদে আমার জন্মদিনে বাবা কলকাতা বইমেলা থেকে আমার জন্য একটা উপহার এনে বলেন,"অপু, তোর জন্য আজ যে উপহার এনেছি সেটা দেখে তুই একেবারে চমকে উঠবি।"


আমি উপহারের মোড়কটা খুলতেই যা দেখি তাতে আমি সত্যিই চমকে উঠি, একটা লাল বই! আমি হতবাক হয়ে বাবার দিকে তাকাতে বাবা বলেন,"দেখলি,আমি বললাম না,তুই এমনই অবাক হবি,তবে এখনও আরও অবাক হওয়া বাকি আছে,বইটা খুলে দেখ আগে।"


আমার তো তখন প্রাণ ওষ্ঠাগত, আবার সেই ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা ভেবে বুকটা আঁতকে  উঠল। আমি ধীরে ধীরে বইটা খুলে ভেতরে তাকায় মনে হয় যেন এই প্রাণপাখি খাঁচা ছেড়ে উড়ে গেল বলে,কিন্তু এ কী! এ কী দেখছি!আমার প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প সংকলন।স্বস্তির শ্বাস ফেলে বাবার দিকে তৃপ্তির হাসি নিয়ে তাকাতে বাবাও ভীষণ খুশি হন।জন্মদিনের  বহু উপহার এখনও রহস্যের মোড়কের আড়ালে রাখা আছে, তার মধ্যে বেশিরভাগ যে বই তা আকার আর ওজন দেখে অনুমান করাই যায়। সেগুলো এখনও ওই অবস্থাতেই আছে, কে জানে, কখন আবার ওর মধ্যে থেকে প্যান্ডোরার বাক্স বেরিয়ে আসে!



                                সমাপ্ত 

5 views0 comments
bottom of page