top of page
Search

বিশেষ সংখ্যা ।। ভয় ভৌতিকে।। বুমা ব্যানার্জী দাস


চোখের আলোয়

   বুমা ব্যানার্জী দাস




তুমুল বৃষ্টির সাথে মিশেছে ঘুটঘুটে অন্ধকার। প্রায় কিছুই দেখা যায়না। গাড়ির ভিতর প্যাসেঞ্জার সিটে বসে অনিমেষ ভাবছে এই ঝড় বৃষ্টি অন্ধকারকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে না বেরোলেই ভালো হত। জয়টা বরাবরই ডাকাবুকো। এখনো, কেমন একটুও না ঘাবড়ে স্থির ভাবে স্টিয়ারিং ধরে বসে আছে। তীক্ষ্ম দৃষ্টি রাস্তার দিকে। কিছু কী আদৌ দেখতে পাচ্ছে ও? অনিমেষের তো মনে হচ্ছে একটা কালো রঙের ক্যানভাসের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ তীব্র এক আলোর ঝলকানি চোখে এসে পড়ে তার। বিশ্রী শব্দে গাড়িটা ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে যায়। জয়ের মাথাটা প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে একবার পিছনে হেলে গিয়েই পরমুহূর্তেই আছড়ে পড়ে স্টিয়ারিং-এর দিকে। গাড়ির এয়ার ব্যাগ ফুলে উঠে মাথাটাকে আঘাতের হাত থেকে বাঁচাতে পারলো কিনা দেখার আগেই জ্ঞান হারায় অনিমেষ। আবার সব অন্ধকার।



- দেখুন, এই হলো আমাদের ব্রেইনের চারটে প্রধান অংশ। সামনের দিকে ফ্রন্টাল লোব, উপরে প্যারাইটাল লোব, নীচে টেম্পোরাল আর পেছনে অক্সিপিটাল লোব। এই অক্সিপিটাল লোব বলতে পারেন দৃষ্টিশক্তির কন্ট্রোল রুম। একটা সহজ উদাহরণ দিয়ে বোঝাচ্ছি। ধরুন, আমি কিছু লিখবো। তাহলে, প্রথমে আমি একটা পেন খুঁজব তো? প্রথমে আমি আমার অক্সিপিটাল লোবের সাহায্যে দেখব পেনটা কোথায়, এই..এই যেমন আমার বাঁ দিকে। এবার বাঁ দিকে কতটা ঝুঁকে বা হাত বাড়িয়ে আমি পেনটা পাব সেটা বুঝতে সাহায্য করে প্যারাইটাল লোব। আমি বোঝাতে পারছি তো?- সামনে উদ্বিগ্ন মুখে বসে থাকা ভদ্রলোকটিকে জিজ্ঞেস করেন বিখ্যাত চক্ষু বিশেষজ্ঞ তথা বৈজ্ঞানিক ডক্টর সুনন্দ ব্যানার্জী।


- আজ্ঞে হ্যাঁ - শুকনো গলায় বলেন কমলেশ বসু।


- বাহ্। এবার আসছে টেম্পোরাল লোব। সেটা কী করে বলুন তো? - কমলেশের চোখ গোল এবং মুখ সামান্য হাঁ হয়।


- আচ্ছা, আমি বলছি। পেনটা দিয়েই যে লিখতে হয়, সেই কথাটা আমাদের স্মৃতি থেকে তুলে আনে এই টেম্পোরাল লোব। এবার আমরা যা দেখি চোখের সাহায্যে, সেটা অগুন্তি নার্ভ দিয়ে এসে পৌঁছয় অক্সিপিটালে। কিন্তু সে একা কী দেখছে কিছুই উদ্ধার করতে পারেনা। বাকি দুটো লোবের সাহায্য তার দরকার হয়। তাই অক্সিপিটাল কী করে, সে যা তথ্য পেয়েছে সেটা পাঠায় টেম্পোরাল লোবের হিপোক্যাম্পাস নামে একটা অংশে।


- কিন্তু দাদার - ক্ষীণ একটা চেষ্টা করে কমলেশ। ঠিক হয়নি মনে হয় এনার কাছে আসা। লোকে যে বলে পাগলা ডাক্তার খারাপ বলেনা।


- আসছি আপনার দাদার ব্যাপারে কমলেশবাবু। একটু ধৈর্য্য ধরুন। হ্যাঁ, আপনার দাদা কিন্তু চোখে দেখতে পাচ্ছেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও দেখতে পাচ্ছেন না। কেন বলুন তো? অ্যাকসিডেন্টটাতে অনিমেষবাবুর ব্রেইনের একটা বিশেষ জায়গা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তার ফলে অক্সিপিটাল থেকে টেম্পোরাল পর্যন্ত ওনার ভিশুয়াল ইমেজ বা সোজা ভাষায় চোখ যেটা দেখছে সেটা যাচ্ছেনা। ফলে উনি যেটা দেখতে পাচ্ছেন সেটা ওনার কাছে অর্থহীন, না দেখার সমান।


- দাদার চোখ ঠিক আছে তাহলে? - কমলেশ ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে।


- একদম - টেবিলে একটা চাপড় মেরে আশ্বস্ত করেন সুনন্দ।


- তাহলে এবার?


- সেটা বলতেই তো ডেকেছি আপনাকে কমলেশ বাবু। দেখুন, ঠিক ওনার মত ইনজুরি আমরা খুঁজছি বেশ কিছুদিন ধরে। কথাটা একটু অদ্ভুত শোনাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু প্রায় পাঁচ বছর ধরে আমি আর আমার টিম নিরন্তর গবেষণা ও পরিশ্রম করে ঠিক এই ধরনের সমস্যার একটা সমাধান খুঁজে পেয়েছি। অর্থাৎ চোখ ঠিক আছে অথচ ব্রেইনের কোনও অংশের আঘাতজনিত কারণে মানুষ দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে। কিন্তু আমরা যথোপযুক্ত পেশেন্ট খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সমস্ত বড়ো হসপিটালগুলোতে বলা ছিল আমাদের। সেইভাবেই আপনার দাদার খবরটা আমি পাই।এবার নেক্সট অফ কিন হিসেবে আপনি যদি রাজী থাকেন তাহলেই আমরা এগোতে পারি। অনিমেষবাবু অবিবাহিত, তাই আপনাকেই অনুমতি দিতে হবে।


কিছুক্ষন চুপ করে থাকে কমলেশ। - কি করা হবে দাদাকে?


ডক্টর সুনন্দ ব্যানার্জীর কপালে ভাঁজ। টেবিলে নখ দিয়ে তবলা বাজান খানিক। তারপর হঠাৎ উঠে দাঁড়ান। - আসুন।


কমলেশ খানিক হতভম্ব হয়। - আরে আসুন, নিজের চোখেই দেখুন - লম্বা পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যান সুনন্দ। তাঁর পেছনে কমলেশ।




- আজ কেমন বোধ করছেন? - নার্সের স্নিগ্ধ স্বরে চোখ মেলে তাকায় অনিমেষ। তবে সেটা নেহাতই প্রতিবর্ত ক্রিয়া। চোখের সামনে সব অন্ধকার। মাথায় মস্ত ব্যান্ডেজ। চোখের নীচে গভীর কালি। ডান পাটা ভেঙেছে। সেখানে প্লাস্টার। উত্তর দেন না কোনও। অন্ধত্ব মেনে নেওয়া বোধকরি সবচেয়ে কঠিন। কাল কমলেশ বলল একজন বড়ো ডাক্তার নাকি তার দৃষ্টি আবার ফিরিয়ে দেবে। আবার সব দেখতে পাবে সে। কি যেন নাম বলল ডাক্তারের?


দরজা ঠেলে কেউ ঢুকলো ঘরে। নার্সের সঙ্গে নীচু গলায় কথা কানে আসে অনিমেষের। কেউ এসে হাতটা ধরে তার। বুঝতে পারে অনিমেষ, ভাই কমলেশ এসে পাশে দাঁড়িয়েছে তার।


- আপনি তো সুস্থ হয়ে উঠছেন অনিমেষবাবু। আসুন এবার নতুন করে পৃথিবীটা আপনাকে দেখানো যায় কিনা দেখি। - কী বলবে অনিমেষ বুঝতে পারেনা। চুপ করে থাকে। টের পায় খুব যত্ন করে তাকে হুইলচেয়ারে বসানো হল। এবার সেটা ঠেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কোথাও। কমলেশ পাশে আছে, টের পাচ্ছে সে।



ডক্টর সুনন্দ ব্যানার্জী অনিমেষকে যেখানে নিয়ে এলেন সেটা যে একটা অত্যাধুনিক ল্যাবরেটরি সেটা বলে দিতে লাগেনা। উত্তেজনায় হাত কাঁপছে তাঁর। তাঁর টীমের বাকি চারজন ঘিরে দাঁড়ায় অনিমেষকে। এতদিনের অপেক্ষা আজ সার্থক হতে চলেছে।


- দেখুন কমলেশবাবু, সেদিন যেমন বলেছিলাম এই হেলমেটের মত দেখতে জিনিসটা আপনার দাদার মাথায় পরিয়ে দেব প্রথমে। এই তারগুলোর মাথায় যে গোল গোল ছোট কাপের মত দেখতে জিনিসগুলো, সেগুলো লাগানো থাকবে কানের পাশে আর মাথার পেছনে। সামনের ওই বড়ো টেলিভিশনের পর্দার মত স্ক্রীনটাতে আপনার দাদা কী দেখতে পাচ্ছেন সেটা ফুটে উঠবে। আপাতত সাদা কালো পুরনো দিনের ভালো সিগন্যাল না আসা টেলিভিশনের মত দেখাবে। এটা একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়। উনি দেখতে পাচ্ছেন কিনা কেবল সেটা পরীক্ষা করার জন্য। এটা যদি সফল হয়, তাহলে খুব ছোট একটা ইনভেসিভ সার্জারি আমরা করবো, কানের পেছনে সামান্য ছিদ্র করে ছোট্ট একটা চিপ বসানো হবে। রেডী এভরিওয়ান? - শেষ কথাটা প্রায় চিৎকার করে বলেন ডক্টর ব্যানার্জী। কথা বলতে বলতে যেখানে যা লাগানোর সব করে নিয়েছেন তিনি।


চালু হয় যন্ত্র। স্ক্রীনে ভেসে ওঠে ঝাপসা ঝাপসা ছায়ার মত কিছু। খুব ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে আসে সেগুলো।


- কী দেখছেন অনিমেষবাবু? ঘরে আমরা আছি, বুঝতে পারছেন।


চোখ বিস্ফারিত হয়ে আসে অনিমেষের। চেঁচিয়ে ওঠে - হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই তো।


চোখের সামনে তিনটে আঙুল ধরে বাচ্চাদের মত আনন্দে জিজ্ঞেস করেন সুনন্দ - কটা আঙুল?


ঠিকঠাকই বলে দেয় অনিমেষ। তারও উত্তেজনা প্রবল।সে সত্যিই আবার দেখতে পাবে!! 


সবাই আনন্দে হাততালি দিয়ে ওঠে।


- ঘরে কতজন আছি আমরা বলুন তো? পরিষ্কার করে মানুষগুলোকে না দেখতে পেলেও কতজন আছি বুঝতে ঠিক পারবেন।


সামান্য চুপ করে থাকে অনিমেষ। গুনছে। তারপর বলে - আমাকে নিয়ে আটজন।


- ভালো করে ধীরে সুস্থে দেখুন, আমরা কিন্তু সাতজন এখানে।


- নাহ্ , আটজনই তো।


চোখ কুঁচকে পর্দার দিকে তাকান সুনন্দ। সত্যি ঝাপসা ভাবে আটটা ছায়াই পড়েছে বটে। যান্ত্রিক গন্ডগোল নাকি ? ঘরে সাতজন থাকলেও অনিমেষ যে আটজনই দেখছে তাতে সন্দেহ নেই। সার্জারিটা হয়ে গেলে এই সমস্যা থাকবেনা বলেই মনে হয়।



সার্জারি হয়ে গেছে। একটু বাদে জ্ঞান আসবে অনিমেষের। সবাই ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে তাকে। অনেক চিন্তা করেও সেদিনের সাতজনকে আটজন দেখার কারণ বুঝতে পারেননি সুনন্দ। দেখা যাক, এবার আসল দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেলে কী দাঁড়ায় ব্যাপারটা।


- অনিমেষবাবু আস্তে আস্তে চোখ খুলুন। আপনার ভাইকে দেখুন সবার আগে।


তাকায় অনিমেষ। প্রথমে প্রচণ্ড বিস্ময় তারপর অপার্থিব আনন্দ ফুটে ওঠে তার চোখ মুখে।


- আমি দেখতে পাচ্ছি!!!!!


- দাদা ডক্টর ব্যানার্জীকে দেখ। ইনি ঈশ্বরের দূত। - সুনন্দের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে হাত জোড় করে নমস্কার জানায় অনিমেষ। 


সুনন্দর উপর থেকে দৃষ্টি ঘুরে যায়, তাঁর টীমের চারজনের দিকে তাকিয়ে আরো পেছনে যায় দৃষ্টি। হঠাৎ এক মুখ হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে অনিমেষ।


- জয়,যাক ঠিক আছিস তুই। উফফ কী হয়ে গেল সব বলত। তোর তাহলে বিশেষ লাগেনি বল। এতদিন আসিসনি কেন দেখতে? এনারা আসতে দেননি বুঝি - উত্তেজিত হয়ে বলে চলে অনিমেষ।


ঘরে হঠাৎ অদ্ভুত নিস্তব্ধতা।


- দাদা - ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে ওঠে কমলেশ - কী বলছিস তুই? জয়দা কোথা থেকে আসবে- সে তো সেদিনই, সেখানেই , ম্ ম্ মানে তখনই - আর বলতে পারেনা কমলেশ। ফ্যাকাশে হয়ে গেছে সে।


ফ্যাকাশে সুনন্দও। এ কী দৃষ্টি দিল সে অনিমেষকে। এ কেমন দৃষ্টিশক্তি যা কায়াময়দের পৃথিবী পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে কায়াহীনদের জগতে। কায়াহীনরা কী এইভাবেই থেকে যায় আমাদের পাশে, আমাদের একেবারে ধরা ছোঁয়ার মধ্যে? আমরা কেবল সাধারণ দৃষ্টিশক্তি দিয়ে দেখতে পাইনা তাদের? এবার কোন জগতে বাস করবে অনিমেষ?


দুই হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়েন বিজ্ঞানী।

74 views0 comments
bottom of page