top of page
Search

রবীন্দ্র ভাবনায় অয়ন ঘোষ



তুমি কি কেবলই ঠাকুর

অয়ন ঘোষ

শ্রীকৃষ্ণের নাকি একশ আটটা নাম ছিল পুরান কথা অনুযায়ী, কিন্তু তুমি তো কৃষ্ণ নও বাপু। কৃষ্ণ চরিত্রটি ঐতিহাসিক, লৌকিক না পৌরাণিক তা প্রমাণ করতে গিয়ে কথা পাল্টা কথায় রাশি রাশি গাছ কাটা পড়েছে, শব্দের ওপর শব্দ জড়িয়ে ত্যাগ, ভোগ, মোক্ষ, পূর্ণ ব্রহ্মর কথা আর দর্শনের জট পেকে এমন অবস্থা যে তোমার অগ্রজ সাহিত্য সম্রাট কেও সেই প্যাঁচ খুলতে মাঠে নামতে হয়েছে। তোমার তো সেসব ঝামেলা নেই, জন্ম মৃত্যু দুটোই ভালো করে নথিবদ্ধ করা। তোমার মৃত্যুর সময় আমরা মানে বাঙালিরা একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিলাম, তাতে আর দোষ কি বল, তোমার মতো কজনই বা তার আগে এসেছিল আমাদের জীবনে। তুমি প্রথম নোবেল লরেট, একডাকে পৃথিবী চেনে। যারা তোমার গায়ে কালি ছিটিয়ে কলকে পাবে ভেবেছিল, তারাও সাময়িক থেমে ফুলবাবু সেজে, উপস্থিত ছিল আম্রকুঞ্জের সভায়। তুমি একটু কড়া কথা বলতে তাদের সে কি গোঁসা। তোমার শেষ যাত্রায়, তোমার শরীর ঠাকুরবাড়ির হাত থেকে লুট হয়েছিল বললে অত্যুক্তি হবে না। তুমিই তো বলেছিলে খ্যাতির বিড়ম্বনা থাকে, এটাও তো সেই। অতি উৎসাহে তোমার চুল, নখ, ধুতি পাঞ্জাবি একটু আধটু ছিঁড়ে নিয়েছিল, যদি পড়ে ভালো দামে কাটে বা স্তুপটুপ বানানো যায়! এমন দেশ আমাদের যে, ছেলের হাতে আগুন টুকুও পেলে না। আসতে চাওনি তুমি শান্তিনিকেতন থেকে। কি জানি আঁচ করেছিলে কিছুটা হয়ত। সারা জীবন শান্তি পাওনি, মৃত্যুতেও পেলে না। আসলে তোমাকে নিয়ে কাটাছেঁড়া, গালমন্দ সবই করা যায়। তুমি যে ঠাকুর, পাথরের। এখন তো আবার কেউ কেউ তোমায় "দুপুর ঠাকুর পো" এর পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে,ওই যে কি একটা সুইসাইড নোট লিখেছে, তার নাকি ভারী বিক্রি, বেস্ট সেলার! যে বাঙালি স্কুলের সিলেবাসের বাইরে তোমায় এক লাইনও পড়েনি, রবীন্দ্র ঠাকুর কি লিখেছিলেন বললে "বর্ণ পরিচয়" বলে, আমি তাদের বাড়িতেও ওই বই দেখেছি। আসলে বটতলার বৌদিবাজি ভেবে কিনেছে, সেই সঙ্গে চায়ের দোকানে আসর মাতানো যাবে। প্রকাশক গুলোও তেমন কারণ এই দেড়শো বছর পরেও অনেক স্ব ঘোষিত রথী মহারথীর থেকে তোমার কাটতি এখনও অনেক বেশি। তোমার ব্র্যান্ড ভ্যালু আকাশ ছোয়া এই জেট যুগেও। দিনদিন বাড়ছে বই কমার কোনো লক্ষণই নেই। রাঙামাটির দেশে তুমি যা যা শুরু করেছিল, আমাদের শহরে রমরমিয়ে চলছে এখন, পাবলিক খাচ্ছেও খুব। যাদের প্রাইমারি ইস্কুল পেরোনোর কথা নয়, তারাও বাসন্তী রঙের শাড়ি বা পাঞ্জাবি পরে গাল রাঙিয়ে বিশ্ব বিদ্যালয়ের বেড়া ভাঙছে। ফলে যস্মিন দেশে যদাচার, দু একটা অপশব্দে আপত্তি থাকতে নেই, এতো গেলো গেলো করার কিছু নেই, তুমি না ঠাকুর। তোমার গানের মধ্যে দু একটা গালাগাল ভরে দিলে কি আর এমন ক্ষতি হবে ঠাকুরের, তাই না।


ফি বছর মাঠে ময়দানে দেওয়ালে, হ্যান্ডেলে, ওই স্ট্যাটাস নাকি বলে একটা সেখানে তোমার জন্মদিন নিয়ে যা শুরু হয়েছে সরকার না একটা কার্নিভালের ঘোষনা করে বসে, রেডরোড জুড়ে "রবীন্দ্র মিছিল", অতি উৎসাহী হয়ত স্লোগান তুলে দেবে "রবি ঠাকুর অমর রহে", "আসছে বছর আবার হবে" বা পাড়ার মোড়ে প্যান্ডেল বেঁধে মূর্তি এনে পাঁজি দেখে কটা ডিজে এনে আমোদ, ভাসানের দিন নং ওয়ান পরের দিন ফানসান ( ফাংশান নৈব নৈব চ)। এসব যদি নাও হয়, গরীবের ঘরে চারটে নকুল দানা বা জল বাতাসা মাস্ট, তোমার ওই পদবীর বিভ্রাটে যেরকম ঠাকুর হয়ে উঠছ, জানি না আর কতদিন নাগাল পাবো, মন্ত্র তন্ত্র এখনও বোধহয় হয়নি, তবে হতে কতক্ষন! সেই গেলো বারে আমাদের গ্রামে গাজন মেলার সময় ভারী হুজ্জত। কমিটি "রবিন্দ নৃত্যের পোতিযোগিতা" ( প্রতিযোগিতা নয় কিন্তু, ওই সব র'ফলা য'ফলার, দিন গেছে বাংলা ভাষার) আয়োজন করেছে। সারাদিন "আলাউন্সমেন্ট" চলেছে, সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান। দু একটা "নিত্য" হয়েও গেছে। দর্শক খুব খুশি, কেউ কেউ মন মরা "বিটের" গান হচ্ছে না বলে। এমন সময় এক অভিভাবক তুমুল বিতর্ক শুরু করলেন, তার কন্যা নাম দিয়েছে কিন্তু বিচারক মন্ডলী তাকে সুযোগ দিতে রাজি নয়, কারণ সে যে গানে নাচতে চাইছে সেটা রবি ঠাকুরের গান নয়। মেয়েটির বাবার যুক্তি এই গানটিও কোনো একটি ভক্তিমূলক গান, সুতরাং এটা ঠাকুরের গান আর রবীন্দ্র নাথের পদবী যেহেতু ঠাকুর তাই অংশ গ্রহণ না করতে দেওয়াটা খুবই অন্যায়। তিনি সরল বিশ্বাসে জানেন রবি ঠাকুর, ঠাকুরই।


আমিও তো তাই জানি, কিন্তু তুমি যে উৎসবের ঠাকুর নও, প্রাণের ঠাকুর। ওই দেখ শিলং পাহাড়ে বৃষ্টি নেমেছে। গাছ গুলো যেনো অসম্ভব প্রলাপে মেতেছে। হাওয়ার টানে ছুটে চলেছে মেঘের দল। গ্রীসের কোনো আম্পিথিয়েটারের পাশেই কৃষি আর মদিরার দেবতা ব্যাখাসের পুজোর বিলম্ব হচ্ছে বলে শশব্যস্ত, তাই অমন গোল্লাছুট। জলপাই রঙের একটা ওভার কোটে শরীর ঢেকে লম্বা লম্বা পা ফেলে আসছে অমিত রায়, পকেটে নতুন কবি নিবারণ চক্রবর্তীর নোটবুক। লাবণ্য আজ পড়েছে সাদা রঙের জামদানি, খোঁপায় এক গোছা বুনো পাহাড়ী ফুল। অবাধ্য দু একটি চুল নিবারণের নোট বুকে ধরা পড়বে বলে বার বার এসে পড়ছে কপোলে, কপালে। তার হাতে বাহারি বটুয়া, তার মধ্যে ভুবনডাঙার কবির কয়েক ছত্র রয়েছে সংগোপনে যা তার বিজন ঘরে এনে দিয়েছিল মুখচোরা শোভনলাল। লাবণ্য মনে মনে ভেবে রেখেছে আজ এগুলো দিয়ে চমকে দেবে অমিতকে। দীঘি কি আর ঘড়ায় তোলা জলের প্রত্যাশী? বয়ে যাওয়া স্রোত আর মুঠো থেকে বেরিয়ে যাওয়া মুহূর্ত, দুই শাশ্বত পথের যাত্রী, তাকে ধরতে চাওয়া বৃথা। নিমেষের মালা গেঁথে গেঁথে, সে বইতে থাকে মনের কিনার বরাবর। কখনও কখনও কোনো পথ হারানো পথিক ক্লান্ত প্রতিচ্ছবির খোঁজে এসে তার পাড়ে বসে, নিজের রূপ দেখে চকিত উল্লাসে মুগ্ধ হয়ে ঢেউ ভেঙে ভেঙে আরশি নগরে গিয়ে পৌঁছায়, আঁজলা ভরে জল নিয়ে তেষ্টা মেটায় অলীক দুপুরে কোনো রাইকিশরীর কাছ হতে। ছায়াপথ পেরিয়ে হাওয়ার দল মুঠো ভর্তি করে নিয়ে আসছে রাশি রাশি জোনাক ফুল। শালবীথি জুড়ে নেশা নেশা জোৎস্না নেমেছে, সেই রূপোলি আলোর দাগ বরাবর ঋজু শরীর নিয়ে, নীচু মুখ পিতা হেঁটে যাচ্ছে দিগন্তের দিকে, পাঁজরে আছারিপিছারি ধাক্কা মারছে নিদাঘ শোক। পুত্র বিয়োগের মনস্তাপ বিটপী লতার মতো পায়ে পায়ে জড়িয়ে ধরছে ভাঙনের সুরে, জোৎস্না রাতে সবাই বনবাসী, যেখানে যেমনটি থাকার সব তেমনি আছে শুধু তার শমী নেই...!! দুঃখী কাঁধে বুড়ো ডানা ভাঙা পাখিটার মতো চেপে বসে আছে কন্যা ভাসানের বেদন, শেষ রাতের দিকে পাতার শরীর থেকে ঝরে পড়া ক্লান্ত শিশিরের রেখাপথ ধরে মৃত্যু বারবার এসে হাত পেতে দাঁড়িয়েছে তার দুয়ারে, তিনি ফেরানো তো দুর, কণা মাত্র নয়, "স্বাহা" মন্ত্রে পূর্ণ আহুতি দিয়েছেন বেদজ্ঞ ঋষির ন্যায়। ঠাকুর না হলে পারে বলুন এতো গুলো মৃত্যুর আদর সহ্য করতে, তাদের সোহাগ করতে। তাই তো আমরাও জানি আমাদের সব প্রলাপ, আঘাত, অত্যাচার, কাটাছেঁড়া, তারপর যদি ভালোবাসা কিছু বেঁচে থাকে তুমি সব সহ্য করতে পারবে, যদিও মাঝে মাঝে বলবে "সহেনা যাতনা", তবু আমরা ছাড়বো না তোমায়। তুমি যে ঠাকুর, ঠাকুর, ঠাকুর...

32 views0 comments
bottom of page