top of page
Search

স্বাধীনতা ।। ধারাবাহিকে অয়ন ঘোষ ।। ধুলোমুঠির গান -২


ধুলোমুঠির গান


অয়ন ঘোষ


এমনিতেই এই ফাগুন চৈত্র মাস আমার খুব পছন্দের নয় (এই রে মশাই সবটা পড়ুন তারপর রে রে করে উঠবেন)। আমারও অবিশ্যি দায় আছে আত্মপক্ষ সমর্থনের। কত কাব্য, কবিতা, গান গল্প এই মধুমাস নিয়ে। গাছে গাছে রঙ, মনে মনে ধিকধিক করে জ্বলছে প্রেমের আঁচ। বাতাস উচাটন, মন উড়ু উড়ু। এই ঋতুতে না গড়পড়তা বাঙালির কবিতা পায়, না গরম না ঠান্ডা এই সময় জেগে ওঠে নাতিশীতোষ্ণ প্রেম। সামনে আবার আসছে পয়লা বৈশাখ , প্রশ্ন ভেসে বেড়াচ্ছে মুখে মুখে, "এইবার পয়লা বৈশাখটা কবে পড়েছে রে। উইক এন্ডে পড়লে না, হেব্বি মস্তি হতো মাইরি। ওইদিন কিন্তু একটা চিলড পার্টি করা যেত।" সব কিছুর সাথে পয়লা বৈশাখের বিশ্বায়ন দেখে বাঙালি হিসেবে বুকটা গর্বে লালমোহন গাঙ্গুলির মতো ফুলে ওঠে। তা এই সময়টায় প্রোফাইলে পলাশ ফুলের ছবি না থাকলে সমাজ কিন্তু আপনাকে সহজে মেনে নেয় না, বলে দিলাম। এবারে বাঙালি পড়েছে ফ্যাসাদে, ভাইরাসের ভয়ে চার দেওয়ালের মধ্যেই নানান দৃশ্য সাজিয়ে দিন কাটছে। কোথায় সে শিমুল পলাশ ভিজবে, না টানা ঘরে বসে বসে ৩৬ কোমর তার ৩৮ এর দিকে। পুরো যেনো মেল ট্রেনের রিজার্ভেশন বগিতে থাকা। ঘুম থেকে ওঠে ব্রাশ করে চা খেয়ে জানালা দিয়ে খানিক তাকিয়ে দেখা, সেখান থেকে পাশের কুপে থুড়ি পাশের ঘরে একটু বউ ( পরিচিত সহযাত্রী) এর সাথে কথা, ফেরার পথে বাথরুম ঘুরে নিজের সিটে এসে আবার লম্বা হয়ে যাওয়া। পড়ে পাওয়া অবসরের এই অত্যাচার ক্রমে ক্রমে দুর্বিষহ মনে হচ্ছে। আর তাতে এই চৈত্রের নিশুতি বেলা!



জানালার পাশে সেই কখন থেকে বুক ফাটিয়ে ডেকে যাচ্ছে, একটা বেক্কেলে পাখি। কাকে হারালো কে জানে? শুনে বুঝি মন খারাপ হয় না? বুকের ভিতর টা খাঁ খাঁ করে। সেই ছোটবেলা থেকেই আমার চৈত মাস এলেই কেমন যেনো কান্না পায়। কেনো পায় ঠিক বলতে পারব না। সব বৃষ্টি যেমন মাটি পায় না, সব জলেরও কারণ হয় না। চৈত্রের বুক খালি করা দুপুরগুলো গিলতে আসে আর তারই মাঝে ইশারার নাগাল পেরিয়ে ডেকে যায় কোনো বাউল পাখি, শুধিয়ে যায় বুকের মাঝে বসত করে ক'জনা? গরম হাওয়ার ঝাপট এলোমেলো করে অতি যত্নে সাজানো নাটক। দম বন্ধ করে অপেক্ষা পর্দা নেমে আসার। পর্দা নামলেও অভিনয় শেষ হয় না। কাঁচা রঙের গন্ধে গা গুলিয়ে ওঠে, জল দিয়েই জল ঢাকি, তবে চোখ কি আর এমনি এমনি লাল হয়। যে বোঝার সে ঠিকই বোঝে। কিছু বলে না কারণ সেও তো একই গল্পের অন্যদিক ধরে আছে। যাক গে, এখন তো আরই অবসর। দু চোখ পেতে দেখি গড়িমসি করতে করতে দিনও যেনো খানিক বিরক্ত। কানের কাছে এসে বলছে, কাজ নেই বাপু, কেবলই আমার পানে চেয়ে থাকা। আগে তো সাধলেও তাকাতে না। তা তোমার সব দলবল কোথায় গেলো? শেষে এই মাঝ বয়সে এসে আমার প্রেমে পড়লে না কি? তার মাঝে বারান্দার নিচের রাস্তাটা দেখি হা পা ছড়িয়ে জিরিয়ে নিতে নিতে বিড়বিড় করছে, ভাল লাগে না বাপু। শুয়ে বসে শরীরে যেনো জং ধরে গেলো। বুঝলাম ওদের দশা আমার মতোই। দিনরাত মানুষের ছোঁয়া পেতে পেতে, সেটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। হটাৎ করে সেই অভ্যাস থেকে সরে আসতে সবারই কষ্ট হয়। যে বলে, হয় না, সে নিজেকে ঠকায়। ছেড়ে আসবো বললেই কি ছেড়ে আসা যায়? এমনি এমনি কি আর কবি চৈত্র দিনে তার চোখে সর্বনাশ দেখলেন?



নিষেধ সত্ত্বেও গিয়ে দাঁড়াই জলের কিনারে কিনারে। বোকা ঢেউ জলেই হারায়। ছোট ছোট গল্প গুলো ধিঙ্গী মেয়ের চুবড়ীতে মুখ লুকিয়ে লুকোচুরি খেলে। নুন লঙ্কায় কষি আমে কামড় বসায়। দাঁত আমলে ওঠে। সহজ করে মনে পড়ে কঠিন কথা। সারা শরীরে কম করে তেত্রিশ জায়গায় গোপন কথারা আলাপ করে। হাত রাখলে নিষিদ্ধ ব্যাথারা বেজে ওঠে জিয়ন কাঠির ছোঁয়ায়।

অলীক দুপুরগুলো ধীরে ধীরে গাঁয়ের ধুলোপথ ধরে এগোয় পদ্মদীঘির ঘাটের দিকে। সান বাঁধানো ঘাটের মাথায় বুড়ো অশ্বত্থের ফিনফিনে ছায়া। বয়সে বুড়ো হলে কি হবে এখনো রস ষোলোয়ানা। কতো গপ্প যে ধরে রেখেছে তার পাকা মাথায়, তার কোনো শেষ নেই। পায়ে পায়ে গিয়ে আমিও দাড়াই ওরই গা ঘেঁষে, সুধই আজ কি রঙ্গ দেখলে, কত্তা। তা রঙ্গের কি আর শেষ আছে। পিরীত যে সত্যিই কাঁঠালের আটা। যদি একবার মন মজাও সখী, সহজে ছাড়বে না। আর সে যদি না ছাড়ে তো তুমি শেষ, এই মধু মাসের রাক্ষুসী দুপুর তোমায় শান্তি দেবে না। আর এই রাক্ষুসী কিন্তু ঠাকুরমার ঝুলি থেকে উঠে আসা নয়, যে এর প্রাণ ভোমারর খবর নিয়ে লালকমল নীলকমল তাকে নিব্বংশ করে আসবে। এর প্রাণ ভোমরা যে তোমার হাড় পাঁজরের ভেতর গোঁসাই। এই কাঠামোয় তার থেকে নিস্তার পাবার সাধ্য তোমার নেই। তার চেয়ে মন বাড়াও, শান্তি পাবে।



আংটির মাপে আঙ্গুল, না আঙুলের মাপে আংটি। ঘরের মাপে মন, না মনের মাপে ঘর। তর্কটা চলতেই থাকুক যেমন খুশি। ফিরে এসে যোগ দেব। জানি কোনো সমাধান মিলবে না, তবু তর্কের খাতিরে কিছু কথা তো হবেই। এই মাগ্গীগণ্ডির বাজারে তাই বা কম কিসের। এখন সে ভাবে আর কথা হয় কই, শুধু প্রতিক্রিয়া জানানো। আর রিফ্লেক্স আ্যকশন কিন্তু কথা নয়। মনের কথা শোনার লোক কমে যাচ্ছে বলে কথা কমে যাচ্ছে তা নয়, মনের কথা বলার সাহসও কমে যাচ্ছে। বাড়ছে চিৎকার, কথার পিঠে কথা। তাতে মন শীতল হচ্ছে কই? সেই যেন চল্লিশের দশকে জন্ম নেওয়া এক্সিস্টেনশিয়াল দর্শনের যেনো পুনরাবৃত্তি। চারিদিকে অজস্র আওয়াজ, কিন্তু তার মধ্যে কোনো বার্তা নেই, নেই কোনো শ্রোতা।

সবেতেই কেমন যেনো আদেখলাপনা। যেনো তেনো প্রকারে জাহির করতেই হবে নিজেকে। ঘরের ভাত খেয়ে, বনের মোষ না তাড়িয়ে কাটছে দিন। তিন কামরার বাড়িতে খোপবন্দী অবস্থা। নিত্য নতুন গল্পের প্রলেপ পড়ছে মনে ফাঁক ফোঁকর জুড়ে। তারই মাঝে নিজের কথা নিজেই হারাচ্ছে গোড়ালি ডোবা জলে। যে প্রতিবেশীদের কথা ছিল এমন শ্রাবণ দিনে নৌকা ভাসানর, তারা এই বন্দর ছেড়ে বহুকাল হলো অন্য মোকামে গিয়ে বসিয়েছে শিকড়, ছায়া দিচ্ছে অন্য কোনো ঘাটে। চড়া রোদ্দুরে ঘুরতে থাকা হা ক্লান্ত মানুষ খুজে বেড়ায় ছায়ার ওই আড়াল টুকু যেমনটি দেখেছি ছোটবেলায়। সন্ধ্যের প্রদীপ যাতে হাওয়ার ঝাপটায় নিভে না যায় তাই দিদা তাকে মনসা তলায় নিয়ে যেতেন ধুণুচির আড়ালে। কেউ কি আছে যার কাছে পাওয়া যাবে ওই সাবেক আলোর আড়ালের আদরটা?



প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরও তো জানা। তাই উত্তরগুলোর সাথে দিনরাত লুকোচুরি খেলা চলে। অঙ্কে কাঁচা তাই গুনতে ভুল হয়, অগত্যা আমিই চোর। সদরের চৌকাঠ পেরোনো মানা আমার ঠিকানা তাই বারান্দা। সেখান থেকেই পোড় খাওয়া নাবিকের মতো তীরের দিকে তাকিয়ে থাকি, নোঙ্গরের অপেক্ষায়। প্রয়োজন ছাড়াই নেশাতুরের মতো ঘুরছে মানুষ, বুকের মাঝে তীব্র আঁধার, রাতও লজ্জা পাচ্ছে নেমে আসতে পারছে এই অন্ধকার তাকেও গ্রাস করে নেয়। পড়ে পাওয়া এই অবসরে দেখি কিছু বিরুদ্ধ স্রোতও মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে রুখে দিতে ওইসব না মানুষী প্রলাপ বা সংলাপ। এরা পরিচয় বিক্রি করে না, নিজেদের আয়োজনকে ভরা হাটে নিলামে তোলে না। চুপচাপ গিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ায়, নীচু স্বরে শুধোয় প্রয়োজন তারপর যে সাহায্যের হাতটা বাড়িয়ে দেয়, সেটা ছুঁতে পারলে ঈশ্বরও ধন্য হতেন। বিজ্ঞাপন সর্বস্ব এই গ্রহে এরা বড়ই বেমানান। এদের সামনে এসে মেকি কৃতজ্ঞতার বিজ্ঞপ্তি মুখ নিচু করে, নীরব হয়। আমি দুর থেকে দেখি আর মানুষ হতে ওঠার ভরসা পাই।




এই নির্বাসনের পৃথিবীতে বসে শুয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে কতো যে রঙ দেখি তার ঠিকানা নেই। যেখানে চোখ আটকে যায়, সেখান থেকে মনের সুতো ছাড়ি। লাট খেতে খেতে সে হাওয়া কাটে, প্যাঁচ কষে বা কখনো ভোকাট্টা। কাটা মন গিয়ে বসে অন্য কোনো কার্নিশে। সেখান থেকে খবর আনে আবার কিছু খবর বিলি করে আসে কানে কানে। সেইসব খবর, আজকের ভাষায় ভাইরাল হলে, আমাকে আর পায় কে! কলম ঠুকে নিজেকে বাহবা দিই। মা মেয়েতে জুলজুল করে তাকিয়ে থাকে, বুঝে উঠতে পারে না, পাগলামির কারণ কি! খানিক পরে নেশা কেটে যায়। বুঝি কিছুই কাজের কাজ হয় নি, শব্দের কাটাকুটি ছাড়া। চুপিসাড়ে সরে আসি ইন্দ্র সভা থেকে। সবাইকে কি সব জায়গায় মানায়!

33 views0 comments
bottom of page