top of page
Search

৪ঠা জুন সংখ্যা ।। ধারাবাহিক উপন্যাস ।। ময়ূখ হালদার



পরিপ্রেক্ষিত [পর্ব ৭(গ)]


ম য়ূ খ  হা ল দা র


ঘন্টা তিনেক টেনে ঘুম দেওয়ার পর শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগছে। একটা বড় চিন্তা মাথা থেকে নেমেছে। যে ক'টা দিন দার্জিলিং-এ আছি সেই ক'দিন আর থাকার জায়গা নিয়ে ভাবতে হবে না- এটা ভেবেই ভালো লাগছে। তার ওপর উপরি পাওনা আজকের হঠাৎ ক'রে কবিতা চলে আসা। সবটা নিয়ে বেশ ফুরফুরে মেজাজেই আছি। মেজাজটাই আসল রাজা- এ কথার মর্ম এখন হাড়ে হাড়ে টের পাই। রাত দশটা কুড়ি। একটা অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল করছি কিছুদিন যাবৎ! যখনই ঘড়ির দিকে তাকাই তখনই কেবল জোড় নম্বর কাউন্ট হয়। এটা কেন হচ্ছে তার কোনও ব্যাখ্যা খুঁজে পাইনি। কিন্তু এমনটাই ঘটছে।



ঘড়ির চলনের সঙ্গে মনের মিল আছে কোনও? এর উত্তর আমার জানা নেই। তবে এটা ভীষণ সত্যি, ভেতরে ভেতরে জোড় বাঁধার সুপ্ত ইচ্ছেটা দিনকে দিন মাথাচাড়া দিচ্ছে। এই যে মনে মনে ফল্গুধারায় বয়ে চলা গাঁটছড়া বাঁধার সঙ্গে সময়ের জোড় কাউন্টের সমানুপাতিক সম্পর্ক- একে কী বলে ? কেন আর কখন এমনটা হয় টিকটিক বয়ে চলেছে সময়। এবার ডিনারটা সেরে নেওয়া দরকার। সবাই ন'টার মধ্যে ডাইনিং স্পেসে গিয়ে খেয়ে এসেছে। আমিই বাকি রয়েছি। রুমবয় রূপেশকে বলে খাবার আনিয়ে নিয়েছি ঘরে। অত সকালে ডিনারের অভ্যাস আমার নেই। ইনফ্যাক্ট কোনদিনই ছিল না। অন্তত রাত এগারোটার আগে তো নয়ই। কেবল মংলুর বাড়িতে থাকাকালীন ওর পীড়াপীড়িতে ওদের সাথে একসঙ্গে সাড়ে আটটার মধ্যে খেতে হতো। এখন থেকে সে সবের বালাই নেই। আপনা হাত জগন্নাথ। রুটি আর ডিম-তরকা চিবোতে চিবোতে মনে হলো কোনদিকে নিয়ে যাচ্ছে জীবন? এভাবে বোহেমিয়ান লাইফ আর কতদিন? এই কি চেয়েছিলাম আমি? আমার দু'টো অপছন্দের কাজ, যেগুলো করতে আমার সবচেয়ে বেশি জড়তা কাজ করে অথচ করতে হয় সেগুলো হলো- নিজের হাতে খাবার বেড়ে নেওয়া আর জামা প্যান্ট কাচা। মা বেঁচে থাকলে হয়তো এগুলো আমায় করতে দিত না। হয়তো কেন, নিশ্চয়ই করতে দিত না। কিন্তু সে তো নেই। অতএব আমাকে এগুলো করতে হবে। মাঝে মাঝে ভাবি, বাবা মা যদি বেঁচে থাকতো তবে কি আমি এইরকম একটা ছন্নছাড়া জীবনকে বেছে নিতে পারতাম? তখন নিশ্চিতভাবেই ছবিটা অন্যরকম হতো। এতদিনে বউবাচ্চা নিয়ে পুরোদস্তুর সংসারী হয়ে যেতাম। কিন্তু সত্যি বলতে আমার বন্ধুদের যখন দেখি, সারাদিন সংসারের ঘানি টানতে টানতে তারা কীভাবে একটু একটু ক'রে জীবনের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে; রোমাঞ্চ হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিদিনের জীবন থেকে- তখন আমার করুণা হয়। শুধুমাত্র বেঁচে থাকার নাম যদি বেঁচে থাকা হয়, তবে সেই বেঁচে থাকার কোনও মানেই হয় না। চোখের পাতায় ভেসে উঠল টুকরো-টাকরা কত ছবি!



রাত জেগে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট, নারকেল চুরি, ফুটবল খেলা, দলবেঁধে নদীতে সাঁতার কাটা, নতুন প্রেমের ঠিকানায় ভ্রমরের মতো ফুলে ফুলে উড়ে বেড়ানো, খোলা আকাশের নিচে তিনতলার ছাদে এক নি:শ্বাসে বিয়ারের বোতল শেষ করার চ্যালেঞ্জ, বছরে দু-তিনটে আউটিং- সবমিলিয়ে কতো রঙিন ছিল সেসব দিন! যা চলে যায় তা কখনো ফেরে না। এরকম কতো না-ফেরাদের আঁকড়ে ধ'রে বেঁচে আছি আজও! বেঁচে যে আছি এটাই আশ্চর্যের! সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে হঠাৎ গালে কামড় খেলাম। এটা আমার প্রায়ই হয় খেতে ব'সে। আমি খাবারের প্রতি মনোযোগ দিলাম। রুটিগুলো বেশ শক্ত। এতক্ষণ পড়ে থাকায় শক্ত হয়ে গেছে। তরকাটা দুর্দান্ত হয়েছে। যে রান্না করেছে মনে মনে তার তারিফ করলাম। খাওয়া শেষ ক'রে প্লেটটা টেবিলের ওপর রেখে হাত ধুয়ে এলাম ওয়াশরুম থেকে। মুখ মুছে উঠে এলাম বিছানায়। ব্লাংকেটটা আধকোমর টেনে বালিশে হেলান দিয়ে সিগারেট ধরালাম। এমন হাড়-কাঁপানো ঠান্ডায় পেটে দানাপানি পড়লে আর গায়ের ওপর গরম জিনিস চাপা থাকলে মজাই আলাদা। শীত অনেকেই পছন্দ করেন না কিন্তু আমার দারুণ লাগে। বিশেষ ক'রে পাতাখসা গাছগুলো কেমন সারবেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে। মনে হয় ওরা প্রত্যেকেই ভিড়ের মাঝে একা। আমি ওদের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাই। একাত্ম বোধ করি। উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকি ওদের দিকে...দেখি। দেখার জন্য দু'টো চোখই যথেষ্ট নয়; দেখতে হয় মনের চোখে। তবেই তাদের মনের কথা পড়া যায়, অনুভব করা যায়। প্রকৃতির সাথে জীবনকে মেশানো একটা আর্ট। তাকে আয়ত্ত করা মোটেও সহজ নয়। বিশেষত লেখায় মেটাফিজিক্স-এর ব্যবহার অন্য মাত্রা এনে দেয়। বাংলায় এক জীবনানন্দ ছাড়া কে-ই বা বিষয়টাকে ঠিকঠাক ধরতে পেরেছেন কবিতায়! তিনি কবির কবি। সত্যি কথা বলতে বাংলা সাহিত্যের বাহক এবং ধারক, কিছু দালালের জন্যই তা পাশ্চাত্য সাহিত্যের সাথে মিশতে পারেনি। কিছু কবি-সাহিত্যিক আর ফড়েদের জন্যই তামাম বিশ্বের এই দুই সাহিত্য শুধুমাত্র তেল আর জল হয়েই থেকে গেল। আসলে আমরা কুয়োর ব্যাঙ হয়েই বেঁচে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। নিজেদের মতো ক'রে তৈরি করে ফেলি কমফোর্ট জোন। আমার পছন্দের চিত্রশিল্পী কৌশিক সরকার একদিন বলেছিলেন, "নিজের ভাষায় লেখো, সাহিত্যের ভাষায় লিখতে যেও না।" কথাটার আপেক্ষিকতার চেয়েও বড় কথা এর গভীরতা আমি সেদিনই টের পেলাম যেদিন থেকে জয়েসকে পড়া শুরু করলাম। তথাকথিত সাহিত্যভাষাকে ভেঙেচুরে দুরমুশ ক'রে তিনি লিখেছেন 'ইউলিসিস', 'ফিনেগান্স ওয়েক' এবং 'ডাবলিনার্স' -এর মতো কালজয়ী উপন্যাস। ভাষাগত ছুঁৎমার্গকে যিনি এক ঝটকায় ছুড়ে ফেলেছেন ওয়েস্টেজ বিন-এ। সেই মহান আইরিশ বিস্ময় জেমস জয়েস আমার চোখ থেকে কালো পট্টিটা খুলে দিলেন। লেখার ক্ষেত্রে বিশেষ ক'রে গদ্যের ক্ষেত্রে কৌশিকদার ইনফ্লুয়েন্স আমার জীবনে একটা বাঁক এনে দিয়েছে- একথা অকপটে স্বীকার করতে আমার কোনও দ্বিধা নেই। জয়েসের ইডিওসিনক্রেটিক ল্যাঙ্গুয়েজ কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না। কৌশিকদাকে সমস্যার কথা জানাতেই তিনি বললেন,

-মাল্যবান পড়েছ?

-না, এখনো পড়া হয়নি।

-পড়ে ফ্যালো। ওখানে মাল্যবানের স্ত্রী উৎপলার ডায়ালেক্ট খেয়াল করো। ওটাই ইডিওসিনক্রেটিক-এর বাংলা উদাহরণ।

-পিডিএফ পাব?

-পেয়ে যাবে।

আমার তর সইছিল না। পড়ে ফেললাম "মাল্যবান"। আবিষ্কার করলাম আরও এক কালজয়ী উপন্যাসকারকে। তিনি আর কেউ নন- জীবনানন্দ দাশ!

আমার একটা কথা সবসময় মনে হয়। যা কিছু সহজ, যা কিছু সস্তা, সেগুলোই পাঠক তেড়েফুঁড়ে খায়। শিল্প কখনও ফ্লুকে হয় না। হতে পারে না। জয়েস "ইউলিসিস" লিখতে ব'সে প্রথম দিন কেবল একটিমাত্র শব্দ লিখতে পেরেছিলেন! এখন যখন বিদেশি সাহিত্য পড়ছি মনে হচ্ছে যেন কত পরে শুরু করেছি! অনেকটা সময় নষ্ট ক'রে ফেলেছি অন্তঃসারশূন্য লেখা পড়ে। তার জন্য আক্ষেপ হয়, চরম আক্ষেপ। এখনও কমলকুমার মজুমদারের লেখা পড়তে পারলাম না অথচ দিব্যি কতই না বাজারচলতি লেখা পড়ে কাটিয়ে দিলাম এতগুলো বছর! ভাবলেই কান্না পায়। গলার নিচে দলা পাকিয়ে ওঠে। শুধুমাত্র লেখার জন্য আমি লিখতে পারবো না। সাত্যকি উপন্যাস লিখতে ব'লে আমাকে এক চরম প্রতিকূলতার মধ্যে ফেলে দিয়েছে! এর আগে যে কটা উপন্যাস ধরেছিলাম একটাও শেষ করতে পারিনি। তবে আমার মনে হচ্ছে এই লেখাটা শেষ করতে পারব। অসমাপ্ত উপন্যাসের কথা উঠলেই ফ্রানৎস কাফকার কথা সবার আগে মনে পড়ে। সদ্য শেষ করেছি তার "দ্য ক্যাসল" এবং "আমেরিকা"। তার বন্ধু সাহিত্যিক ম্যাক্স ব্রড সেই অসম্পূর্ণ লেখাগুলোর পরিণতি দিয়েছিলেন। এমন বন্ধু পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। এখন কে বন্ধু আর কে শত্রু- সব তালগোলে হরিবোল হয়ে যায়! কে যে কখন ছোরা মারবে ধরতে পারবে না! একেবারে সামনে দিয়ে ঢুকবে আর পিছন দিয়ে বেরোবে! বিশেষ ক'রে সাহিত্য লাইনে বন্ধুত্ব করেছ কী মরেছ! এখানে অনেক দল, হাজারো সংগঠন। আমি অবশ্য একা থাকতেই পছন্দ করি। আজকাল কোনও সম্পাদক লেখা চাইলে তবেই দিই। নচেৎ নয়। এ বিষয়ে কিছুদিন আগে ফেসবুকে কথা হচ্ছিল সাহিত্যিক কাবেরী রায়চৌধুরীর সঙ্গে। বর্তমানের সাংস্কৃতিক বাজার ব্যবস্থায় তিনি রীতিমতো বিরক্ত এবং উদ্বিগ্ন। শুধুমাত্র আর্থিক ফায়দা তুলতে আগাছার মত গজিয়ে উঠছে নিত্যনতুন পত্রিকা। সম্পাদকদের ন্যূনতম জ্ঞান এবং সৌজন্যবোধের অভাব আর বিশেষ ক'রে টাকার জন্য বই ছাপানোর এজেন্সি খোলার ব্যাপারকে কোনওভাবেই সমর্থন করা যায় না। সুচারুভাবে অপসাহিত্যকে সাহিত্যের পোশাক পরিয়ে বেচে দিচ্ছে এরা। ফলে লেখক এবং পাঠক- ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন উভয়েই। সর্বোপরি ভেঙে পড়ছে সাহিত্যের কাঠামো। এসব কথা ভাবলেই বমি পায়। ইচ্ছে করে, না ভাবতে। কিন্তু যা পরিস্থিতি তাতে ক'রে চুপচাপ ব'সে থাকাও যায় না। আমার পরিচিত ছেলেমেয়েরা যারা লিখতে শুরু করেছে সবে, চোখে আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন, তাদেরকে সবসময়ই একটা কথা বলি- "ডাল ভাত আর বিরিয়ানির তফাৎ বুঝতে শেখো। লেখক হতে গেলে হাঁস হতে হবে। তবেই তো দুধ আর জলের ভেতর থেকে দুধটুকু শুষে নিতে পারবে।" কোন সম্পাদক অথবা প্রকাশক ভালোবেসে নিষ্ঠাভ'রে সাহিত্য করছেন সেটা বুঝতে হবে। চাইল আর গদগদ হয়ে লেখা পাঠিয়ে দিলাম এমনটা যেন না হয়। আরে বাবা একজন কবি-সাহিত্যিকের আত্মসম্মানবোধ থাকাটা ভীষণ জরুরি। যেভাবেই হোক শিরদাঁড়া সোজা রাখতে হবে। শুধুমাত্র মেরুদণ্ড সোজা না থাকার কারণেই বুদ্ধিজীবীরা মানুষের কাছে হাসির খোরাক হয়ে গেছে। দে আর অল পারচেজ্ড। বিক্রিত পণ্য ছাড়া আর কিছু নয়।



ভাবনার শেষ নেই। ইনফ্যাক্ট ভাবতে আমার দারুণ লাগে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে এখন আমার ভাবতে ইচ্ছে করছে না! আমরা ভাবি, কতকিছুই না করছি। সত্যিই কিছু করছি? নাকি, শুধু ভেবেই যাচ্ছি? ভাবনা আর এগজিকিউশনের মধ্যে হাজার মাইল দূরত্ব! যতক্ষণ না ঠিকঠাক এগজিকিউট করা যাচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত ভাবনার পাঁচনয়া দাম নেই। আমি এখনও উপন্যাসের একটা জুতসই প্লট খুঁজে পাইনি আর এই ব্যর্থতা আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি কি হারিয়ে যাব অন্ধকারে? হেরে যাব এত সহজে? আরও যুদ্ধ, জয়ের স্বপ্ন আমাকে ঘুমাতে দেয় না। আমি দেখি, না-দেখা কোনও মেয়ের হাতে একটা রেড-ওয়াইনের বোতল আর তার ভেতর থেকে ঝরনার মতো গড়িয়ে পড়ছি গ্লাসে! সেই স্প্যানিশ কাসাদেলা- যার হাত আমার কপাল ছুঁয়েছে, যার নরম সুন্দর আঙুলগুলো আমার জ্বরের তরজমা লিখছে, যার পালকের মতো মধ্যমা আমার থার্মোমিটার! আমার সমস্ত ক্লান্তি যেন মেঘ উধাও! আমি লুই ফার্দিনান্দ সেলিনের "জার্নি টু দি এন্ড অফ দ্য নাইট"-এ চোখ রাখলাম।



18 views0 comments
bottom of page