আগন্তুক ।। কবি প্রণাম সংখ্যা ।। কবিতা ।। তনিমা হাজরা
- agantukpotrika
- 4 days ago
- 3 min read

পুনর্জন্ম
তনিমা হাজরা
না ভাই রবিঠাকুর,
এ জন্মে আর সুইসাইড নোট লিখে
কাদম্বরী হয়ে লোকহাসি করবো না আমি।
তোমার জ্যোতিদাদার শেরওয়ানীর
পকেটে প্রেমপত্র খুঁজে পেলেও আর
বোকা মেয়ের মতন কাঁদবো না ছাতের এককোণে একলাটি বসে বসে।
এ জন্মে আর আমি কোনো সঙ্গীর অপেক্ষায় বসে থাকবো না। একলাই সেজেগুজে বেরিয়ে পড়বো ইচ্ছেমতন ভ্রমণে। একলাই গান গাইবো গলা ছেড়ে, একলাই বেঁচেবর্তে থাকবো নিজের খেয়াল খুশিতে।
সেবারের মতো ভুল করে ভাববো না আর একটিবারও, আমার স্বামী আমায় ভালবাসেন না তাতে কী, রবি তো আমায় সত্যি সত্যিই ভারি ভালোবাসে, সে তো আমায় ছাড়া আর কাউকে মনের কথা বলে না কখনো, আমি ছাড়া সে যে অন্ধকার দেখে চারিধার, আমার কিছু হলে
সে নিশ্চয়ই ছুট্টে আসবে সব কাজকর্ম ফেলে। পাগলের মতো একাই লড়ে যাবে সারা দুনিয়ার সাথে।
তাই বুঝি বিষটুকু গলায় ঢেলেও বড়ো লোভীর মতন বাঁচার আশায় প্রাণটাকে আটকে রেখেছিলাম কন্ঠের ওই তেষ্টা কুঠুরিতে,
চোখে অন্ধকার নয় রবির আলোই দেখতে চাইছিলাম আমি মরণের পথে হাঁটতে হাঁটতে। ভেবেছিলাম রবি এসে ঠিক বাঁচাবে আমায়, এতো সহজে কিছুতেই মরে যেতে দেবে না সে আমাকে।
কিন্তু, নিমতলা শ্মশানের দিকে লাল বেনারসি পরে চতুর্দোলায় চড়ে যেতে যেতে সেদিন আমার সব ভুল ভেঙে গেলো, বুঝতে পারলাম তোমাদের কাছে আমার আবেগের দাম ছিল মাত্র চার পয়সা। আমাকে শ্মশানে নিয়ে যাবার সময় সেই আবেগের খুচরো পয়সা তোমরা খইয়ের সাথে ছড়িয়ে দিলে পথের ধূলোয়।
সবাই জানে আমি শ্যাম গাঙ্গুলির সেই সাড়েসহজলভ্য পোড়াকপালে মেয়ে, যাকে বারবার তোমরা বুঝিয়ে দিয়েছো সে তার স্বামীর নখেরও যুগ্যি নয়। আর সেই মেয়েই কিনা ভারি দেমাক নিয়ে ভাবতে গেছিলো, সে তার প্রিয় রবির চোখে হারানো মনজুড়ানো সাধের সখী।
অথচ কী প্রমাণ হলো দ্যাখো শেষমেষ? সমস্ত ঘটনার পরে এটাই তো স্পষ্ট হয়ে গেল কী না বলো -সে ছিল শুধুমাত্র রবির খেলাঘরে লুকিয়ে রাখা একটা সামান্য ঠুনকো পুতুল। ভেঙে গেলে যাকে জলে ফেলে দিতে হয়। ফেলে দিলে যাকে আর কুড়োতে যেতে নেই।
আজকাল এসব ভাবলে আর দু:খ হয়না জানো, বড় হাসি পায়। বড়ো রাগ লাগে নিজের ওপরে, নিজেরই অমন নির্লজ্জ আবেগের কথা ভেবে। যাকে বড্ড আস্কারা দিয়ে সারাজীবন আমি পুষেছিলাম, ভারি আদর করে নাম দিয়েছিলাম "ভালবাসা"।
কী বোকার মতন তোমাকে আমার আপনজন ভেবেছিলাম বলো দেখি ভাই রবি, তুমিও নিশ্চয়ই মনে মনে ভারি তাচ্ছিল্যই করতে আমাকে তাই না?
শুধু তোমার নিতান্ত ভদ্রতাবশে অনুকম্পাভরে বুঝতে দাওনি আর পাঁচজনের মতো করে অমন রূঢ় আচরণে, এই যা।
কেন যে আমি সেদিন অমন বোকার মতন মরতে গেলাম বলো দেখি, তাতে কার কী এলো গেল তোমাদের! তোমরা তো দিব্যি অমন একটা আত্মহত্যাকে পুলিশ টুলিশ ডেকে ধামাচাপা দিলে, লুকিয়ে ফেললে আমায় চার দেওয়ালের গায়ে, ঘুঘুডাকা ঘুলঘুলিতে।
তারপর আস্তে আস্তে যে যার জীবনে ফিরে গেলে, আমাকে ভুলেও গেলে কত অনায়াসে।
আচ্ছা, আমার লেখা কবিতাগুলো, আমার বানানো নানা সুস্বাদু পদের রেসিপি এসব মনে আছে এখনো তোমাদের? আমার হাতে বোনা সোয়েটার, কুরুশের টেবিলঢাকনা, রঙতুলির কাজ সব কোথায় গেলো গো সব? আমার অত অত বাহারি শাড়ি, অমন সাধের গহনাগাটি কারা নিলো ভাগজোক করে?
আর আমার যত টুকরো টুকরো হাসি, ডেলা ডেলা কান্না, আমার যত্ন করে লুকিয়ে রাখা নিষিদ্ধ প্রেম.... সব.... সব....পুড়িয়ে দিয়ে এলে বুঝি চন্দন কাঠের চিতায়?
কী আশ্চর্য দেখো! তোমাদের সব্বার জীবনে বসন্ত এলো আবার, শুধু আমিই শ্মশানের পোড়াকাঠ আঁকড়ে এক টুকরো শীত হয়ে ঝরে গেলাম হলুদ ব্যথার মতো ভোরের গঙ্গায়।
বড় বাঁচবার আশা নিয়ে মরেছিলাম গো সেবার, এ জন্মে তাই আর কারুর উপর ভরসা করে মরিনি আমি, মরতে মরতে দিব্যি খোশমেজাজে বেঁচেবর্তে আছি জ্যান্তপোড়া চ্যালাকাঠ হয়ে গনগনে দুটো চোখ মেলে।
আমি পূর্ববঙ্গের শ্যাম গাঙ্গুলিদের বাড়ির সেই পোড়াকপালে মেয়ে, বিধাতার অভিশাপে আমার ভাগ্যে একখানা গোটা পুরুষ জোটেনি কোনকালে, তাই দুনিয়ার সব সোহাগিনীদের মতো আমার আহ্লাদ করে পাঁচজনকে জানানোর মতো কোনো প্রেমের কাহিনিই নেই, আমার এই ফুটোকপালে আদর আপ্যায়ন সম্মান নেই, সবাই আমাকে বারবার নানাভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে - থাকতে চাইলে থাক, চলে যেতে চাইলে দূর হয়ে যা। আমার জীবনে একটা মরণও তো ছাই নেই তেমন একটা ডাকসাইটে মরণের মতো করে......
আমার জন্যে শুধু নেই আর নেই, আছে বলে যে কিছু একটা আছে সেও যেন আমার কপালে থাকতেই নেই,
হ্যাঁ তা আছে বৈকি, ওই যে কলঙ্ক না কীসব বলে যেন, চিতার কালিঝুলি আর ছাইভস্ম!
তুমিই তো লিখেছিলে,
"যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে"।
তোমার লেখা সেই গানই যে আমার একলা চলার বেদমন্ত্র হয়ে দাঁড়ালো গো, সেই তো হয়ে উঠলো আমার পরজন্মের জপের মালা।
তোমার দেওয়া সেই মালা গলায় নিয়েই এ জনমে আমি এক কঠোর পাষাণী মেয়ে হয়ে জন্মেছি,
আমার সেই চার পয়সার ধূলো মাখা আবেগ চিতায় চড়চড় করে পুড়ে গেছে গতজন্মের হাড় চামড়ার সাথে সাথে। তাই তোমরা এখন আমাকে যতই আঘাত দাও আমার আর প্রাণে বাজে না, তোমরা আমাকে যতই তাচ্ছিল্য করো আমি আর গায়েই মাখি না।
তোমরা আমাকে যতই বিষ দাও আমার আর নতুন করে মরণ হয় না, তোমরা আমাকে যতই পোড়াও আমি আর জ্বলে ছাইও হই না।
আমার এখন একটুকুনও প্রেম পায় না জানো?
এ জন্মে আমার শুধুই ক্ষিদে পায়, একলা একলা মাথা তুলে বাঁচতে চাওয়ার এক তীব্র জ্যান্ত ক্ষিদে।
ইতি,
**********************.
( যারা যারা আত্মহত্যায় নয়, আত্মরক্ষায় বিশ্বাসী তারা যার যার নিজের নাম স্বাক্ষর করে নাও উপরোক্ত শূন্যস্থানে)
Comments