পরিপ্রেক্ষিত
ময়ূখ হালদার
(পর্ব-তিন)
আজ সারাদিন দারুণ কাটলো। পায়ে হালকা ব্যথা নিয়েও দেদার ঘোরাঘুরি আড্ডা খাওয়াদাওয়া চমৎকার একটা দিন। কলকাতায় থাকাকালীন ইউনিভার্সিটি লাইফে কত মস্তি করেছি কিন্তু আজ বাবামায়ের সঙ্গে ঘুরে বেরিয়ে যে আনন্দ পেলাম তা এক্কেবারে অন্যরকম। হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট, জু, তেনজিং রক আর মহাকাল মন্দির ঘুরে এলাম। ফ্যান্টাসটিক এক্সপিরিয়েন্স। সেই ১৯৫৩র এডমুণ্ড হিলারি আর তেনজিং নোরগের এভারেস্ট অভিযান, বিজয়ের স্মৃতি বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এইচ এম আই এবং মিউজিয়াম। ছোটবেলা থেকেই পাহাড় আমাকে ভীষণ টানে রাদার সি বিচ। আইস জ্যাকেট, স্নো অ্যাক্স, টেন্ট, হাইকিং বুট, ক্লাইম্বিং রোপ... স্বপ্নের ইকুইপমেন্টস, নিজের চোখে দেখে এলাম। অ্যামেজিং! সামনেই চিড়িয়াখানা। রেড পাণ্ডাস, মেবার ক্যাট, স্নো লেপার্ড, ভাল্লুক, সাদা বাঘ ছাড়াও রয়েছে হরেক কিসিমের পাখি। মনে পড়ে যায় ছোটবেলায় কলকাতার আলিপুর চিড়িয়াখানায় বেড়াতে যাবার কথা। আর তেনজিং রকের সামনে দাঁড়িয়ে তো রীতিমত গুসবাম হচ্ছিল! তবে মহাকাল মন্দিরে বেশিরভাগ সময়টাই কাটালাম নানারকম মানুষ আর বাঁদর দেখে। এ জায়গাটা মায়ের জন্য অ্যাপ্ট ছিল। আমি বরাবরই ঠাকুর দেবতায় লেস ইন্টারেস্টেড। বাবার এসবে কোনওদিনই বিশ্বাস নেই। তবে মাকে ছেড়ে অন্য কোথাও যেতেও পারছিল না। আমি তো ছবি তোলার বাহানা দেখিয়ে কেটে পড়েছিলাম কিন্তু বেচারা বাবা! না পারছিল গিলতে না উগলাতে। আজ বহুদিন পর ওদের একসাথে হাসি মজাক করতে দেখলাম। খুউব ভালো লাগছিল। সায়েন্স বলে সমমেরু পরস্পরকে বিকর্ষণ করে। অথচ আমি একই ছাদের তলায় বিসম মেরুর পারস্পরিক বিকর্ষণ কলা দেখতে দেখতে বেড়ে উঠেছি! জীবন আসলে অংক নামের সেই গাছ যার অসংখ্য হাত থেকে অকসার ফরমুলাগুলো ঝ'রে পড়া আপেল! আর সেই অভিশপ্ত আপেলগুলো যেন একেকটা রক্তবীজের ঝাড়! ক্রমশ বেড়েই চলেছে। এভাবে চলতে চলতে একদিন পার্থেনিয়ামে ভ'রে যাবে মাটি। থাকবে না দাঁড়ানোর জায়গা! অথচ কী অদ্ভুত, গর্ভনিরোধক বিজ্ঞাপন দেখলেই তৌবা তৌবা তৌবা! ঘোমটার নিচে খেমটা নাচ- হিপোক্রিসি!
ডি এস এল আরের চিপ থেকে ছবিগুলো গ্যালাক্সি নোট প্রো-তে ট্রান্সফার ক'রে আমি ফেসবুক লগ ইন করলাম। গুচ্ছের নোটিফিকেশন জমে আছে। অথচ এত রাতে সেগুলো খুলে দেখতে ইচ্ছে করছে না। মাথাটাও কেমন যেন ধরে আছে। আমি মলয় সান্যালের টাইমলাইনে গেলাম। নাহ্, নতুন কোনও পোস্ট নেই। লাস্ট পোস্ট তিনদিন আগে। দু এক মিনিট নিউজ ফিড স্ক্রল করার পর ফেসবুক লগ আউট করলাম। রাত একটা চল্লিশ। পিন ড্রপ সাইলেন্স। একলা ঘরে একমুঠো নেট দুনিয়া। অ্যাড্রোলেশন পিরিয়ডের যে কোনও ছেলেমেয়ের কাছে এটা আইডিয়াল সময়! এমন রক্তাক্ত নির্জনে আমি অবশ্যই "নোরা" হতে চাই। হতে চাই জয়েস-এঁর প্রেমিকা। আজকালকার ছেলেদের সে হিম্মত কই! জীবনে যে কটা লাভ লেটার পেয়েছি সবগুলোই ছিল একেবারে ন্যাতানো! যেসব লেখা শেষ করার আগেই অকাল বৃষ্টিতে ভিজে যায় বিছানার চাদর, সেসব লেখা ডাকবাক্সে পৌঁছানোর আগেই ভেসে যায় হাইড্রেনে। তাই জয়েস-এঁর চিঠিতেই তৃষ্ণা মেটাতে হয়। "ইউলিসিস" পড়াটা দিনকে দিন ম্যাসিভ অ্যাডিকশনে পরিণত হচ্ছে। এভাবে কতক্ষণ কেটে গেছে খেয়াল নেই। হঠাৎই তলপেটে চিনচিনে ব্যথা টের পেলাম। বই বন্ধ করে ঘুরে এলাম বাথরুম থেকে। ফিরে এসে লাইট অফ করে ঢুকে পড়লাম ব্ল্যাঙ্কেটের ভেতর। ঘুম আসছে না। পি এম এস জানান দিচ্ছে সে আসছে। বারকয়েক এপাশ ওপাশ করার পর চিৎ হয়ে শুলাম। অস্বস্তি কাটছে না কিছুতেই। যদিও এটা নতুন কোনও ব্যাপার না তবুও প্রত্যেকবার ওয়ার্ম আপ ম্যাচে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা। কেন? কীসের জন্য এই ডিসটিংকশন? এটাই স্বাভাবিক। সব মেয়েকেই মেনে নিতে হয়। তাছাড়া প্রথম যখন মায়ের কাছে জানলাম পিউবার্টি মেয়েদের জীবনে পূর্ণতা নিয়ে আসে তখন আমার ভেতরে আনন্দের ছিঁটেফোঁটাও ছিল না বরং কেঁদে কঁকিয়ে উঠেছিলাম অসহ্য যন্ত্রণায়। জীবনে সেই একবারই বিশ্বাস অবিশ্বাস শিকেয় তুলে ঠাকুরকে ডেকেছিলাম মনে মনে। নালিশ জানিয়েছিলাম কেন এই বিভেদ। অভিশাপ দিয়েছিলাম যেন কাল থেকে প্রতিটা ছেলের পিরিয়ড হয়। এখন সেসব কথা মনে পড়লে ভাবি কোন লেভেলের ক্যালাস ছিলাম।
আজ আর ঘুম আসবে না। আমি বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। ঘুমন্ত রুকস্যাকের বুক পকেট হাতড়ে বের করলাম ক্র্যানবেরি ডার্ক। তারপর দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম। মনে হলো গায়ে কয়েক লক্ষ কাচের টুকরো ছিটকে এল! আমি দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে রইলাম যন্ত্রের মতো। একসময় ঠান্ডার তীব্রতা গা সওয়া হয়ে গেলে রেলিং ধরে দাঁড়ালাম। অন্ধকার রাত। সুনশান পাহাড়। ঘুমন্ত শহরের কিনারায় আমি আমার সমস্ত একাকিত্ব বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি একা একা। অথচ আমার তো একা থাকার অভ্যেস কোনওদিনই ছিল না। ছোটবেলা থেকেই আদুরে বিড়ালের মতো বেড়ে উঠেছি একটু একটু ক'রে। বহরমপুরের কে এন কলেজের পাঠ শেষ করে ভর্তি হলাম ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে। "কোলকাতা" শব্দটা বড্ড ঝ্যাং ঝ্যাং করে কানে বাজে।
আমি মাস্টার্স করেছি বাংলা সাহিত্য নিয়ে। খুব ভালোবাসি পড়তে, আঁকতে, নাচতে, গাইতে। সেইসঙ্গে ভালোবাসি গুছিয়ে আড্ডা মারতে। ন্যাচারালি কফি হাউস, ফেভারিট কেবিন, বসন্ত কেবিন, পুঁটিরাম... এই নামগুলো নেশার মতো চারিয়ে গেল রক্তে। আমি, টিউলিপ, সুপর্ণা, ইদ্রিশ, অলকানন্দা, সুমি, বীরেশ আর সন্দীপন- এই ছিল আমাদের অষ্টবসু।
আমি আর টিউলিপ থাকতাম শ্যামবাজারে। পেয়িং গেস্ট লেডিজ পি জি। দশ, ভূপেন্দ্র বোস এভিনিউ। আমরা দুজন একই রুমে থাকতাম। আমাদের সঙ্গেই থাকতো রাজিতা। সুরেন্দ্রনাথ কলেজের ফার্স্ট ইয়ার। ইংলিশ অনার্স। ফুটফুটে সুন্দর মেয়েটার আদল ছিল নেপালিদের মতো। পরে জেনেছিলাম ওর বাবা বাঙালি আর মা নেপালি। বাড়ি ছিল কল্যাণীতে। ওকে আমরা কোনওভাবেই ডিস্টার্ব করতাম না। আর সেও আমাদের ব্যাপারে নাক গলাতো না। ইনফ্যাক্ট রাজিতা নামের মেয়েটার সাথে একপ্রকার অলিখিত শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। আর এ ব্যাপারে টিউলিপের ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো। পরে অবশ্য জানতে পেরেছিলাম এর আসল কারণ। একদিন রাতে হঠাৎই ঘুম ভেঙে গেল আমার। ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে উঠলাম। কিছু বলার আগেই টিউলিপ আমার ঠোঁটদুটো মুখের ভেতর পুরে নিল। ওর অবাধ্য হাত আমার মাইদুটো চটকাচ্ছে পাগলের মতো। প্রথমে টি-শার্টের ওপর দিয়ে, পরে অবলীলায় হাত ঢুকিয়ে দিল ভেতরে। টিউলিপের বাল্কি চেহারা। আমি সামান্য নড়তেই ও আমার ওপর শুয়ে পড়লো। নড়ার ক্ষমতা নেই আমার। অথচ সমানে এলোপাথাড়ি খেলে যাচ্ছে আমার শরীরটা নিয়ে! আমি আড়চোখে তাকালাম রাজিতার বিছানায়। ঘুমে কাদা। এদিকে টিউলিপ ক্রমশ ভয়ংকর হয়ে উঠছে! এবার বীর বিক্রমে হাত ঢুকিয়ে দিল আমার প্যান্টির ভেতর! প্রতিরোধ করার শক্তি হারিয়ে ফেললাম। দুহাতে খামচে ধরলাম ওর থলথলে পিঠ!
পরেরদিন সোমবার। সারাক্ষণ ক্লাসে বসে রইলাম থম মেরে। রাসসুন্দরীদেবীর আত্মজীবনী "আমার জীবন" নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। আমার চোখের সামনে কেবলই ভেসে উঠছে দুটো ল্যাংটো মেয়ের শরীর। ছায়া ছায়া মেঘের মতো আবছা। আমি কিছুতেই স্থির থাকতে পারছি না। আমার ভালো লাগছে, নাকি খারাপ... সেটাও বুঝতে পারছি না! ভেতরে ভেতরে একধরণের চাপা অস্থিরতা। আমি ভীষণভাবে চাইছিলাম একটু নির্জনতা। লেকচারের পর সবাই মিলে চেপে ধরলো আমায়। শুধু টিউলিপ মাঝে মধ্যে মুখ টিপে হাসছে। আমি কিছুতেই ওদেরকে বলতে পারলাম না সত্যি কথাটা।
-একটা ভাইটাল কাজ আছে। আমি উঠলাম। তোরা বোস।
কথাটা এক নিঃশ্বাসে শেষ করেই হাঁটতে শুরু করলাম। চেষ্টা করছিলাম কত তাড়াতাড়ি কেটে পড়তে পারি। এখন একটু একা থাকা দরকার। কিন্তু কোথায় যাবো? চারপাশে এত লোক! কোথায় পাবো একটু নির্জনতা? আমি ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে রাস্তা পার হয়ে ফুটপাথ ধরলাম। ডানদিকে টার্ন নিয়ে ঢুকে পড়লাম বিদ্যাসাগর উদ্যানে। সবে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হব হব করছে। এখন তেমন ভিড় নেই। বসলাম একটা ফাঁকা জায়গায়। গোল পুকুরের জলের দিকে তাকিয়ে বসে আছি চুপচাপ। গত রাতের ছবিটা চোখ থেকে কিছুতেই সরছে না। কেন আমি টিউলিপের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়ালাম না? আমিও কি আসলে উপভোগ করছিলাম ওইসব মুহূর্তগুলো? সকালে বেরোনোর আগে রাজিতা আমার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হেসেছিল। কেন? ও কি কালকে আমাদের ওই অবস্থায় দেখেছিল? শুয়েছিল ঘাপটি মেরে? সকাল থেকে একটা ব্যাপার লক্ষ করছি, টিউলিপ হঠাৎ 'তুমি' করে কথা বলা শুরু করেছে। অবশ্যই সেটা একান্তে। কী চায় ও আমার কাছে? ভালোবাসা? নাকি, আনকন্ডিশনাল সেক্স? আমি কি লেসবিয়ান? মনে তো হয় না। সন্দীপনের ঘামের গন্ধ আমার বেশ লাগে। ভালো লাগে ওর কথা বলার স্টাইল। হয়তো মনে মনে ওকে চাইও! তাহলে? এখন কী করবো? পিজি চেঞ্জ করলে কেমন হয়? কী বলবো বাড়িতে? হাজারো প্রশ্ন গিজগিজ করছে মাথায়। আমি ব্যাগ থেকে বোতল বের করে জল খেলাম। খানিকটা মাথায় ঢাললাম।
-আর ইউ ও কে?
সামনে দাঁড়িয়ে দুটো ছেলে। ওদের চিন্তামুক্ত করলাম।
-আই অ্যাম ফাইন।
ওরা হাসিমুখে এগিয়ে গেল। আচ্ছা, ওরা কি গে? ধুর! কী যে হচ্ছে! পিজিতে ফেরার কথা ভাবতেই অক্ওয়ার্ড ফিল করলাম।
-হোলি শিট! তুমি এখানে বসে আছো!
ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম! সামনে গ্যাদগ্যাদে শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে টিউলিপ! হোয়াট দ্য ফাক! আমি হড়হড় করে বমি করে ফেললাম। হঠাৎ সবকিছু ব্ল্যাক আউট হয়ে গেল!
রাত তিনটে কুড়ি। ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে নিজেরই শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ। ভটকতি আত্মা! ভূতে বিশ্বাস করি না অথচ ভূত আমার ঘাড়ে চেপে দিব্য ড্যাং ড্যাং করে নাচছে! ঘুমন্ত শহরের পেটের ভেতর ঘুমিয়ে আছে সারি সারি লাশ। দিনের আলোয় যারা গিরগিটির মতো রং পাল্টে জ্যান্ত হয়ে ওঠে। মেতে ওঠে অযাচিত কোলাহলে। রাস্তাঘাটে রেস্তোরাঁয় শপিং মলে ট্রেনে বাসে দোকানে বাজারে মুরগির পালকের মতো ঝ'রে পড়া দিনের শেষে যান্ত্রিক যৌনতায় ক্লান্ত লাশগুলো ঘুমিয়ে পড়ে শিশুর মতো। বাঁচা মরার মাঝে নিয়মিত মদ্যপান। ধর্ম রাজনীতি আর দখলদারির আগুন-ককটেল নেশা। মাতালের ঘুম। আমি এদের ভালোবাসি। ভালোবাসে ঘেন্না করি।
অসাড় নাক আর গালে কাচ-কাটা জ্বালা নিয়ে ঘরে ঢুকলাম। নিজেকে অচেনা লাগে। ভাবি, কোনটা আসল আমি! ভাবনার লেয়ারগুলো সব এলোমেলো হয়ে যায়। মেন্টাল ক্লক কি বায়োলজিক্যাল ক্লকের মতোই টাইম অ্যান্ড স্পেসের সাথে পাল্টে যায়? ফেলে আসা সময় যেন কাঁকড়ার দাঁড়। যতই সামনে এগোতে যাই ততই পেছনে টানে।
আমি সিগারেট ধরিয়ে বালিশে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে দিলাম। এখন আগের চেয়ে বেটার ফিল করছি। হয়তো এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম বলেই পা'দুটো টানটান মেলে দেওয়ায় আরাম লাগছে। স্মোক রিং বানাবার ফান্ডাটা শিখেছিলাম সন্দীপনের কাছে। জিভটাকে লম্বালম্বি ভাঁজ ক'রে ডগাটা একটু বেঁকিয়ে খেপে খেপে ধোঁয়া ছাড়লেই বেরিয়ে আসবে স্মোক রিং। প্রথম দিকে ব্যাপারটায় মজা পেলেও কখন যে অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি। একেক সময় মনে হয় সমস্ত যন্ত্রণা যদি এভাবে উড়িয়ে দিতে পারতাম!
দিনের পর দিন ভেতরে ভেতরে ছিবড়ে হয়ে যাচ্ছিলাম। সময়ের সাথে সাথে টিউলিপের চাহিদাও বাড়ছিল পাল্লা দিয়ে। আমি কিছুতেই রিয়ালাইজ করতে পারছিলাম না একটা ব্যাপার। টিউলিপকে কেন বাধা দিতাম না! আমাদের সেক্সুয়াল ব্যাপারটা একটা সময়ের পর শুধুই অভ্যাসে পরিণত হলো। প্রথম দিকে অক্ওয়ার্ড লাগলেও পরে গা-সওয়া হয়ে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত বুঝতে পেরেছিলাম এখানে কোনও প্রেম ভালোবাসার গল্প নেই। নেহাতই জৈবিক একটা সম্পর্ক। এদিকে সন্দীপনের ওপর ফিদা আমি। এমনকী টিউলিপের সঙ্গে সেক্স করার সময়েও আমি সন্দীপনকেই ইমাজিন করতাম। একটা মারাত্মক লেভেলের অবসেশন আর কী! সেই বছরই পুজোর ছুটির আগের দিন বিকেলে ওকে সমস্ত বিষয়টা খুলে বললাম। ইনিশিয়ালি ভয় ছিল, এসব কথা বলাটা উচিত হবে কিনা। কিন্তু সত্যি বলতে আমি আর চাপ নিতে পারছিলাম না। বুকের ভেতর জগদ্দল পাথর নিয়ে কাহাঁতক ভালো থাকা যায়! সন্দীপনকে বিশ্বাস ক'রে বললাম সব কথা। ও পুরোটা শুনলো চুপ ক'রে। আমিও রিল্যাক্সড হলাম। দু'জনেই চুপচাপ বসে আছি। না কথা না বার্তা! আমি লক্ষ করলাম ও কিছু ভাবছে। ভাবুক। সময় নিক। দুম ক'রে আলটপকা কোনও একটা ডিসিশন নেওয়ার চেয়ে ভেবেচিন্তে পা ফেলাই ভালো। সিগারেট ধরালাম। ওর যেন কোনওকিছুতেই ভ্রূক্ষেপ নেই। ভাবছে তো ভাবছেই। আধাঘন্টা কেটে গেল। আমি অধৈর্য হলাম।
-কী রে, আর কতক্ষণ চুপ ক'রে থাকবি? কিছু তো বল।
-হ্যাঁ? ... হ্যাঁ বলবো। আমাকে একটু সময় দে।
-ওকে। ভেবেচিন্তে জানাস। চল এবার ওঠা যাক।
ওর কোনও হেলদোল নেই। আলতো ক'রে বলল,
-তুই চলে যা। আমি আরেকটু বসি।
অন্য সময় হলে ওকে ছাড়তাম না। এখন মনে হলো ওকে স্পেস দেওয়া দরকার। আমি উঠে দাঁড়ালাম।
-ঠিক আছে তুই বোস। আমাকে টিউশন যেতে হবে। নাহলে আমিও থাকতাম। চল, টা টা।
ও হাত নাড়লো আমার দিকে তাকিয়ে। আমি হাঁটতে শুরু করলাম। আলো-আঁধারি আউটট্রাম ঘাট আর অস্তগামী সূর্যকে ফেলে আমি এগিয়ে চললাম স্ট্র্যান্ড রোডের দিকে।
লম্বা ছিপছিপে শ্যামবর্ণ ছেলেটার বাড়ি বরানগর। ৭১-এর অনেক গল্প শুনেছিলাম ওর কাছে। নৃশংসতার জঘন্য ছবি ভেসে উঠতো চোখের সামনে। রক্তমাখা লাশ সাদা কাপড় আর অসহায়তার সঙ্গে রিলেট করতে পারতাম "হাজার চুরাশির মা!"
ওর মোবাইল নম্বর আজও ডিলিট করিনি আমি। ভ্যাকেশনের দিনগুলো যেন কাটতেই চাইতো না। কেবলই মনে হতো কত তাড়াতাড়ি শেষ হবে ছুটি। রোজ ফোন করতাম। কোনও নির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই। ভালো লাগত। স্বার্থ বলতে এটুকুই। আমি ওর কাছে একবারের জন্যও ওর ডিসিশন জানতে চাইনি। বলেছিল, ছুটির পর ইউনিভার্সিটিতে দেখা হলে সারপ্রাইজ দেবে।
একাদশীর দিন সন্ধেবেলা, ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে নিউজ দেখছিল বাবা। আমি বন্ধুদের সাথে ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। বাড়ি ফিরলাম যখন, ঘড়িতে সাতটা বেজে পাঁচ। সাইকেলটা সিঁড়ির নিচে রেখে সবেমাত্র জুতো খুলছি, হঠাৎই শুনলাম...
পথ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেন সন্দীপন ভৌমিক নামে বরানগরের এক যুবক। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের...
( ক্রমশ...)
Comments