top of page
Search

ধারাবাহিকে ময়ূখ হালদার - ১

Updated: Jul 13, 2021


ree

পরিপ্রেক্ষিত (পর্ব- এক)


ম য়ূ খ  হা ল দা র


...তারপর আমার অবচেতন মন আমাকে টেনে এনে দাঁড় করালো আয়নার সামনে। এতদিন ধ'রে দমিয়ে রাখা ইচ্ছেটা হঠাৎই যেন রান্নাঘরের দরজা খোলা পেয়ে ঢুকে পড়া বিড়াল! বেহেড মাতাল হয়ে নাক ডাকছে সিকিউরিটি চেতন। দিব্য শুনতে পাচ্ছি তার নাক ডাকার শব্দ। প্রচণ্ড ঘুমের মধ্যেও কখনও কখনও সাড়া দেয় চেতনা। নার্সিসিসের ঘুম ভাঙছে একটু একটু ক'রে। আমি কাঁচাপাকা দাড়িতে হাত রাখলাম। মনে হলো, দাবানলে ঝলসে যাওয়া একখণ্ড আমাজন! তবু ভালো লাগছে। আধপোড়া জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এল কোকিল, অক্ষত ডানায়। এখন ডিসেম্বরের মাঝরাত। অথচ বসন্ত এসে গেছে! আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম কোকিলের ডাক!


-মিঃ সান্যাল!


হলুদ পুল ওভারের কোটর থেকে উঁকি দিচ্ছে কোকিল। কলকাতার রোদজ্বলা পাখি নয়। অনেকটা স্প্যানিশ ধাঁচের মুখের আদল। কাঞ্চনজঙ্ঘার কোলে কাঞ্চনকন্যার হাসি রাশি রাশি কাঞ্চন ছড়িয়ে দিল আমার মরুভূমি চোখে। থমকে গেল আমার বানজারা মন।




-হোয়াট আ সারপ্রাইজ! আপনার সাথে এখানে এভাবে দেখা হয়ে যাবে... জাস্ট ভাবতেই পারছি না!


আমার হাতে একক-দশক-শতকে ফুরিয়ে যাচ্ছে সিগারেট। কুয়াশার ভেতর দিয়ে চোখ রাখলাম কাঞ্চনকন্যার চোখে। আমাকে ঘিরে আছে কয়েকজন বেহালা-বাদক! ছড়ের ভেতর থেকে উদ্ভূত আগুন ছড়িয়ে পড়ছে আমার শিরায় শিরায়! আমি ভাসতে ভাসতে পৌঁছে গেলাম Jerez De La Frontera- র তিন হাজার বছরের পুরনো সেইসব চার্চ আর দুর্গের আনাচেকানাচে। আমি ডুবে যাচ্ছি সেই প্রাগৈতিহাসিক মদের নেশায় আর সবচেয়ে তেজি ঘোড়াটার লাগাম শক্ত ক'রে ধরে রেখেছি বুক পকেটে।


-আমি তিথি, তিথি সরকার। আপনার কবিতার ফ্যান। আপনার ফেসবুক ফলোয়ার, ফ্রেন্ড...

-ওহ্! কিছু মনে করবেন না আমি ঠিক চিনতে পারছি না।

-চিনতে পারছেন না? "কবিতার খোঁজে"...

দ্যাটস ইট! তাহলে আপনিই "কবিতার খোঁজে!"

-জ্বি জনাব।


তিথি অবাধ্য চুলগুলো সরাতে সরাতে ঠোঁট নাড়লো,


- বাই দ্য ওয়ে আমি আপনাকে নাম ধ'রে ডাকতে পারি? ইনফ্যাক্ট, মিঃ সান্যাল বড্ড বেশি ফরম্যাল লাগছে।

-বেশক।

-থ্যাঙ্ক ইউ মলয়দা।


আমি তিথির হাসির প্রত্যুত্তরে হাসি ফিরিয়ে দিলাম। আসলে এরকম অদ্ভুত পরিস্থিতিতে আগে কখনও পড়িনি। মেয়েটাতো আমাকে রীতিমতো সেলিব্রিটি ভাবছে! এ যে কী বিড়ম্বনা! অথচ আমি যে কতটা নগন্য, সাধারণ... তা কী ক'রে বোঝাই! কবির জীবন কোনও ফ্যান্টাসি কিংবা লার্জার দ্যান লাইফ নয়। একজন কবিতাপ্রেমীর এটা বোঝা উচিত। যেখানে আমি চূড়ান্ত বাস্তববোধ থেকে লিখে থাকি সেখানে দাঁড়িয়ে তিথির আমাকে নিয়ে আদিখ্যেতাটা বড়ো বেশি চোখে লাগছে।


-কী ভাবছেন?

-কিছু না, চলুন চা খাই।


তিথি আমার পাশে পাশে হাঁটতে শুরু করলো।

-আপনার "লাইট হাউস" কিন্তু আমার কাছে আছে।

-বাহ্, ভালো লাগলো শুনে।

-আপনার কাব্যগ্রন্থ আমার কাছে থাকবে না, তা কখনও হয়! সত্যি বলতে আপনার কবিতা ভাষা একদম অন্যরকম। আই মিন, আটমোস্ট রোমান্টিসিজ্ম থেকে বেরিয়ে যেভাবে আপনি জীবনের গভীরে পৌঁছে যান... সেটা আমার ভীষণ ভালো লাগে। কবিতা মানেই চাঁদ তারা প্রেম... এ মিথ কবে যে ভাঙবে!

-আমার কবিতাতেও কিন্তু চাঁদ তারা আছে।

-হ্যাঁ আছে, তবে তাদের প্রয়োগটাও তো দেখতে হবে। চাঁদ তারা সূর্য মেঘ- এগুলো আপনার লেখায় রক্ত মাংসের তৈরি বলে মনে হয়। যেন পাশের বাড়ির ছেলেমেয়ে, একেবারে বন্ধুর মতো। এই যে ডিসট্যান্স ব্রেকিং- এটা আমার দারুণ লাগে।


আবার সেই বেহালা বাদকরা ফিরে এসেছে! এবারে একেবারে মোৎসার্ট সিম্ফনি, কানের কাছে! একটা রিনরিনে সুখ, খুশির আমেজ আমাকে উড়িয়ে নিয়ে গেল ভেনিসে।


-মলয়দা শুনছেন?


গান থেমে গেল।  মিউজিশিয়ানরাও নেই। দার্জিলিং শহরের ম্যালের একটা ছিমছাম ক্যাফে। ভিড়ের মধ্যে আমি আর তিথি।


-হ্যাঁ, বলুন।

-কী ভাবছেন?

-আপনার কথা।

-মানে?


তিথিকে সত্যি কথাটা বলতে পারলাম না। আসলে সত্যিটা কী সেটাই আমার কাছে ধোঁয়াশা। আমি নিজেকে হাড়েমজ্জায় চিনি। আমি হলাম সেই ধরণের হুলো যে সারাদিন এপাড়া-ওপাড়া ঘুরেও মেনি যোগাড় করতে পারে না! অথচ আনকা মেনি দেখলেই ভালো লেগে যায়; স্বপ্ন দ্যাখে। আমতা আমতা করে বললাম,


- না মানে, আপনি যে কথাগুলো বললেন সেগুলোই মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।

-অমি কি ভুল কিছু বললাম?

- না, এটা ভীষণ রকম সত্যি। আপনার অ্যানালিসিস আমার ভালো লেগেছে।

-ওহ্, থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ।


তিথি একঝাঁক মুক্তো ছড়িয়ে দিল। আমি না পারলাম কুড়োতে, না পারলাম ছাড়তে! ব্যাপারটা এরকমভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে- যে সমস্ত অঞ্চলে খুব কম বৃষ্টিপাত হয় বা একেবারেই হয় না; সেখানকার মানুষেরা আকাশে হঠাৎ করে মেঘ দেখলে যেরকম উল্লসিত হয় পাগলামি করে, ঠিক সেইরকম আমার হ্যাংলামি বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে তেড়েফুঁড়ে। আর আমি সর্বশক্তি দিয়ে তাকে আটকে রাখার চেষ্টা করছি। শালা! বলে কিনা,  আপনার অ্যানালিসিস আমার ভালো লেগেছে! অথচ মুখ ফুটে বলতে পারলো না-আপনাকে আমার ভালো লেগেছে! ভাবনার কী ছিরি! চেনা নেই জানা নেই হঠাৎ করে প্রথম দেখায় একথা কাউকে বলা যায়! সততা আর সাহস থাকলে নিশ্চয়ই বলা যায়।  একদম চুপ! দেখছিস না- দুটো "স" কেমন পাঁজর থেকে বেরিয়ে কবরের দিকে হেঁটে যাচ্ছে!


-বেয়ার্ড লুকে আপনাকে দারুণ লাগে।


আমি হালে পানি পাওয়া চোখে তিথির দিকে তাকালাম। 

- বেয়ার্ড লুক বুঝি আপনার পছন্দ?

তিথি চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখে টেবিলে। হাসে।

-আমার পছন্দ অপছন্দতে কী এসে যায়! সন্ধ্যা হয়ে এল। চলুন এবার ওঠা যাক।

আমি বিল মিটিয়ে সিগারেট ধরালাম।

-তিথি আপনি কোথায় উঠেছেন?

-হিমালয়ান ইন।

-তাহলে ভালোই হলো। আমিও তো ওদিকেই যাবো। চলুন আপনাকে এগিয়ে দিই।

-আপনি কোথায় আছেন?

-আমি কোনও হোটেলে উঠিনি। ভুটিয়া বস্তিতে এক পরিচিতর বাড়িতে থাকছি।


তিথি হাসলো।

-কবি সাহিত্যিকদের এই একটা প্লাস পয়েন্ট। বিভিন্ন জায়গায় পরিচিত কাউকে না কাউকে পেয়েই যান তাঁরা।

-ব্যাপারটা তেমন নয়। ভুটিয়া বস্তিতে যার বাড়িতে উঠেছি তার নাম মংলু থাপা। ড্রাইভার। বেশ কয়েক বছর আগে তাও প্রায় আট-দশ বছর তো বটেই, এখানে এসেছিলাম। আমাদের সাইট সিয়িংয়ের জন্য যে গাড়িটার ব্যবস্থা করা হয়েছিল হোটেল থেকে মংলু সেই গাড়িটার ড্রাইভার ছিল। সেই থেকে পরিচয়। আমাকে বহুবার ইনভাইট করেছে। কিন্তু এর আগে তেমন সুযোগ হয়ে ওঠেনি। বাই দ্য ওয়ে, আপনি কি একাই এসেছেন?


ম্যাল রোডের দুপাশে সারি সারি দোকানের দিকে তাকিয়ে তিথি হাঁটছিল। ওর মুখের স্মিত হাসি দেখে বোঝা যাচ্ছিল ও কতটা খুশি। অবশ্য এক ঝলক বাইরে থেকে দেখে কারো সম্পর্কে সঠিক ধারণা করা যায় না।  বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুল হয়। তবে তিথিকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। সময় বড়ো অদ্ভুত! কিছুক্ষণ আগেও আমি একা এবং সম্পূর্ণ একা ভবঘুরের মতো হেঁটে বেড়াচ্ছিলাম। যাদের হাতে অঢেল সময় তারাই সময়কে ভাগ করে। আমি তো বাঁচি মুহূর্তে। তাই দিনরাতের হিসেব করা হলো না আজও!


- না, বাবা-মাও এসেছেন। ওঁরা হোটেলেই আছেন। আমি বোর হচ্ছিলাম ঘরে বসে। ভাবলাম যাই একটু ঘুরে আসি। ভাগ্যিস বেরিয়েছিলাম! নইলে তো আপনার সাথে দেখাই হতো না!


আমি তিথিকে হাসি ফিরিয়ে দিলাম। আমাদের দেখা হওয়াটা কি নিয়তি নির্ধারিত ছিল? নাকি ইত্তেফাক! নাহলে চার্চবাজার থেকে তো ম্যালে ফিরেছি অনেক আগেই। ফেরার পথে চৌরাস্তা অফ শপ থেকে শার্ক টুথের দুটো খাম্বাও তুলেছি। তারপর সোজা মংলুর ওখানেই যাওয়ার কথা। অথচ কেন যে ম্যালে দাঁড়াতে গেলাম! আর তিথিও ঠিক সেই সময়ই ওখানে পৌঁছালো! আশ্চর্য সমীকরণ! শীতের সন্ধ্যা। অন্ধকার  নামছে স্লগ ওভারের ব্যাটিং এর মতো। আমি তিথিকে হিমালয়ান ইন-এ পৌঁছে দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলাম সি আর দাস রোড বরাবর। কিছুক্ষণ পর অ্যাক্সিস ব্যাঙ্ককে বাঁ-দিকে রেখে উঠে পড়লাম ভুটিয়া বস্তি রোডে।


আমি যখন মংলুর বাড়িতে পৌঁছলাম তখন সাতটা বেজে গেছে। কাঠের তক্তা আর বিম দিয়ে তৈরি ছোটখাটো বাড়ি। বেশ পুরোনো। ফেন্সিংয়ের ভেতরে সামনের দিকে কিছুটা ফাঁকা জায়গা। বাঁদিকে মংলুর গাড়ি রাখার জায়গা মাঝখানে যাওয়া-আসার জন্য একফালি জমি ছেড়ে যেদিকটায় বারান্দা থেকে আলো  ঠিকরে পড়েছে সেদিকে, ডানদিকে, টিউলিপ লিলির বেগুনি হলুদ ম্যাজেন্টা রঙের ফুলের বাহার আর অর্কিডের বাগান। আমি মাঝখানের সরু ধাপকাটা পথ ভেঙে উঠে এলাম চাতালের ওপর।


সাধারণত রাত আটটার মধ্যে এখানে সবাই ডিনার সেরে নেয়। তারপর ঘন্টাখানেক গল্পগুজব সঙ্গে দু তিন পাত্তর মদ। ওরা ড্যাগার জাতীয় লিকারে অভ্যস্ত আর আমি ফরেন। সবাই চলে যাওয়ার পরও আমি দেদার গিলতে লাগলাম। শীতের রাত। বাইরে কি বরফ পড়ছে? বড্ড ইচ্ছা করছে বাইরে বেরিয়ে একবার দেখে আসি। কিন্তু ফায়ারপ্লেসের আগুন আর লেপের ওম্ ছেড়ে কে ভাই এই হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডায় বাইরে বেরোয়! দেখতে দেখতে ভালোই জমে উঠেছে মৌতাত। আমার ঘোলাটে চোখের দৃষ্টি হঠাৎই আটকে গেল আয়নায়!


-বেয়ার্ড লুকমে আপ বহুত আচ্ছে লাগতে হো!

-কে!

আমি আধো অন্ধকারে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে চমকে উঠলাম! মনে পড়ল, তিথি আজ বাদুড়ের মতো ঝুপ করে নেমে আসা সন্ধ্যায় একথা বলেছিল আমায়। আচ্ছা তিথি এত রাতে এখানে কী করছে? আর ও হিন্দিতেই বা কথা বলল কেন? নাঃ! নেশাটা মনে হচ্ছে জোরদার হয়ে গেছে। কোনও রকমে টাল সামলালাম ড্রেসিং টেবিলটা ধ'রে। তখনও বুঝতে পারিনি আমার জন্য কোন মাইনকার চিপা ওৎ পেতে আছে! কৈশোরে আমরা নদীতে ছিপ ফেলে ফাতনার দিকে তাকিয়ে ওৎ পেতে থাকতাম- সেইসব চঞ্চল মুহূর্তগুলো উঁকি মেরে গেল চোখের কোনে। দরজাটা সামান্য নড়ে উঠল না? কী সব আজগুবি ভাবনা! মদ খেয়ে নিজেকে সামলাতে পারো না অথচ মদ খাও কেন! ধুত্তোর! নিকুচি করেছে শালা! আমি কারোর বাপের টাকায় মদ খাই না। নেশা করি গাঁড় উল্টে পড়ে থাকি- যা খুশি করি, তাতে কার বাবার কী? হাসছো কেন? অ্যাই! চেনো আমায়? আমি কবি! কবি মলয় সান্যাল! তোমাদের মতো পুরস্কারের লোভে দিদিমণির আঁচল ধরে ঘুরে বেড়াই না। ওসব পুরস্কারে আমি ছড়ছড় করে মুতি! দেখবি? দাঁড়া... এই দ্যাখ... যাঃ শালা! গেল কোথায়! জমে গেল নাকি ঠাণ্ডায়! আমার কী হলো? হঠাৎ করে সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে কেন?


-কে! কে ওখানে?

-আমি।

-তুমি এখানে কী ক'রে এলে ভাই?


দু পা এগোতেই হোঁচট খেয়ে আছড়ে পড়লাম তিথির গায়ে। ওর নরম তুলতুলে বুকদুটো ঘষা খাচ্ছে আমার বুকে। থেকে থেকেই ঝাঁকুনি দিয়ে কেঁপে উঠছি আমি! এত সুখ!


-বদতামিজ কহিঁ কা! ছোড়ো মুঝে!


হঠাৎই প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়লো ঘরের ভেতর! আর হাজার বছরের লজ্জা আমার গলা চেপে ধরলো! রোশনি! আমি কী মানুষ! নেকড়েটাকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও। আমার সংকুচিত শরীরটা লুটিয়ে পড়লো ঘরের মেঝেতে আর মনটা ছিটকে বেরিয়ে এল বারান্দায়!

.............................


(ক্রমশ... )

 
 
 

Comments

Couldn’t Load Comments
It looks like there was a technical problem. Try reconnecting or refreshing the page.

Subscribe Form

Thanks for submitting!

©2021 by Agantuk Potrika.

bottom of page