যশোদা মিষ্টান্ন ভান্ডার
সমীরণ সরকার
(৫ম পর্ব)
হরপ্রসাদের আশঙ্কাই সত্যি হয়েছিল।
সেদিন পদ্মাবতী ঘনশ্যাম চক্রবর্তীকে অনুরোধ করে, 'আদর্শ হিন্দু হোটেল' এর পিছনে ঘনশ্যাম চক্রবর্তীর বাড়িতে নিয়ে গিয়ে, মাধব কে স্নান করিয়ে সাফসুতরো করেছিলেন। বাজার থেকে নতুন জামা প্যান্ট কিনে এনে ওকে পরিয়ে দিয়েছিলেন। ঘন্টাখানেক সময়ের মধ্যেই পুরনো মাধবের চেহারা বদলে গেছিল। এরপর হোটেলে খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে তারকেশ্বরে লোকাল ট্রেন ধরতে বেলা তিনটে বেজে গেছিল।
এরপর কামারকুন্ডু স্টেশনে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর বর্ধমান যাওয়ার লোকালশ্ন তখন জেলার সদর শহর সিউড়ি তে ফিরে যাওয়ার ট্রেন চলে গেছিল। সদর শহর সিউড়ি ফিরতে পারলে একটু রাত হলেও গাড়ি ভাড়া করে রাজপুরে যাওয়া যেত।
কাজেই বাধ্য হয়ে হরপ্রসাদ স্ত্রী পদ্মাবতী আর মাধব কে নিয়ে মাসতুতো বোন সুনন্দার শ্বশুরবাড়িতে গেছিলেন। সুনন্দা হইহই করে উঠেছিল,খুব খুশী হয়েছিল। কিন্তু মাধব কে দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছিল।পরে পদ্মাবতীর মুখে সবকিছু শুনে বলেছিল, এটা তুমি কি করলে বৌদি? আমি জানি, তুমি দয়ালু।তাই বলে একটা রাস্তার ভিখারির ছেলেকে ঘরে নিয়ে এলে? আর দাদা, তোমাকেও বলিহারি, বৌদি বললো আর তুমি সেটা মেনে নিলে!
হরপ্রসাদ বললেন,নারে, তুই যা বলছিস ,সেটাঝ্ঝ ঠিক নয়। ও ব্রাহ্মণ সন্তান, ওর গলায় যজ্ঞোপবীত আছে।
------ ছাড়তো দাদা , গলায় সুতো ঝুলালেই বুঝি
বামুন হয়ে যায়,!
পদ্মাবতী এতক্ষণ চুপচাপ ছিলেন। এবার মুখ খুললেন, তাহলে আর কি করলে বামুন হয় ঠাকুরঝি?
----- নিজের ছেলে থাকতেও আবার একটা বাচ্চা পোষার এত সাধ যখন তোমার মনে ছিল
বৌদি, আমাকে বললেই পারতে।
------ কি করতে তুমি ?
------ মা ষষ্ঠীর দয়ায় আমার তো তিনটে ছেলে আছে, একটা না হয় তোমাকে দিতাম,তুমি মানুষ করতে ।মা আর মামি কি আলাদা নাকি!
------ জানতাম না ঠাকুরঝি, আমাকে এত ভালোবাসো তুমি। কিন্তু এখনতো আর উপায় নেই, মাধব চলে এসেছে।
----- কে মাধব?
মাধব কে কাছে টেনে নিয়ে পদ্মাবতী বললেন, এইতো মাধব, আমার মাধব।
সুনন্দা ঠোঁট উল্টে বলল, একেবারে ঠাকুর দেবতার নাম দিয়ে দিলে বৌদি?
----- আমি দিইনি। এই নামটা উল্কি কেটে ওর ডান হাতে লেখা আছে। এই দেখো।
পদ্মাবতী মাধবের ডান হাতটা তুলে দেখালেন।
হরপ্রসাদ প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বললেন, এখন ওসব বাদ দে তো 'সুনি', আমাকে তাড়াতাড়ি কিছু খেতে দেতো,খুব খিদে পেয়েছে আমার।
----- ওমা তাই তো! দিন দিন আমি কেমন 'ভুলো' হয়ে যাচ্ছি। তোমরা হাত মুখ ধোও দাদা, আমি তোমাদের জন্য খাবার নিয়ে আসছি।
সুনন্দা রান্নাঘরের দিকে চলে যায়।
পদ্মাবতী স্বামীকে বলেন, কাল সকালে আমাদের এখানে যাওয়ার ট্রেন কটায় গো।
----- কাল সকালে তো সিউড়ি যাওয়ার কোন ট্রেন নেই, বেলার দিকে আছে।
------ বেলার দিকে মানে? সিউড়ি কটায় পৌঁছাবে?
----- তা প্রায় বেলা সাড়ে বারোটা হবে।
---- তার মানে রাজপুর পৌঁছতে তো বেলা গড়িয়ে যাবে।
----- হ্যাঁ, ঠিকমতো বাস পেলে আড়াইটা তিনটা নাগাদ পৌঁছে যাব।
---- সে ত অনেক দেরি হবে। আমার বাছা ততক্ষণ না খেয়ে থাকবে?
-----তা কেন? সিউড়ি বাস স্ট্যান্ডে অনেক হোটেল আছে। খেয়ে নেব কোন একটাতে।
----- না না, সে হবে না। ছেলেটা এছ ঠিকমত খেতে পায়নি। আমি ভেবেছিলাম কাল নিজের হাতে রান্না করে ছেলেটাকে দুটো ডাল ভাত খাওয়াবো।
---- সেটা কাল নাহলে পরশু খাওয়াবে।
----- না না, আমি কালকেই খাওয়াবো। কাল সকালে এখান থেকে লোকাল ট্রেন ছাড়ে না?
--- হ্যাঁ ,খুব সকালে ছাড়ে। কিন্তু ওই ট্রেনটা তো সিউড়ি যাবে না।
----- আমরা আমোদপুর এ নেমে গাড়ি ভাড়া করে সোজা রাজপুর যাব।
----- অনেক টাকা গাড়ি ভাড়া নেবে।
---- তোমাকে দিতে হবেনা টাকা,আমি দেব।
------ বাহ! তাহলে তো ভালোই।
----- কিপটে কোথাকার।
হ্যাঁ পরদিন ভোরেই স্বামী আর মাধব কে নিয়ে ট্রেন ধরেছিলেন পদ্মাবতী। সুনন্দার হাজারো আপত্তি বা অনুরোধে মত পাল্টাননি পদ্মাবতী।
আমোদপুর এ নেমে একটা ভালো রেস্টুরেন্টে মাধব কে পেট ভরে খাইয়েছিলেন পদ্মাবতী।
হরপ্রসাদ ও সামান্য জলযোগ করেছিলেন। পদ্মাবতী এক কাপ চা ছাড়া আর কিছুই খাননি।
তারপর স্টেশনের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগলোর ড্রাইভার এর সঙ্গে রাজপুরে যাওয়ার ব্যাপারে কথা বলেছিলেন।
হরপ্রসাদ একবার চেষ্টা করেছিলেন স্ত্রী কে বোঝাতে ,যাতে গাড়ি রাজপুর পর্যন্ত ভাড়া না করে সিউড়ি পর্যন্ত করা যায়।
পদ্মাবতী বললেন, বললাম তো ভাড়ার টাকা আমি দিয়ে দেবো।
আর কথা বাড়ান না হরপ্রসাদ।
(তিন)
সকাল সাড়ে দশটার মধ্যে রাজপুরে পৌঁছে যায় ওরা। মাধবের সেই রাজপুরে আসা, পদ্মাবতীর হাত ধরে। তারপর অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেছে। মাধব এখন যুবক।
(চলবে)
Comments