top of page
Search

অক্ষয় সংখ্যা ।। ছোটগল্প ।। মিঠুন মুখার্জী


কালি প্রসাদের কীর্তি


মিঠুন মুখার্জী



ঈশ্বর প্রেমী ও পশু প্রেমী আমরা অনেক দেখেছি কিন্তু কালি প্রসাদের মত কাউকে দেখিনি। যেসব বিষয়কে আমরা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করি, গুরুত্ব দিই না, তাদের প্রতি কালি প্রসাদের অভাবনীয় আকর্ষণ আমাকে অবাক করত। জন্মেছিল পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার গোবরডাঙ্গার কাছে লক্ষ্মীপুর নামের একটি ছোট্ট গ্রামে। ছোটবেলা থেকে ওর ছিল বেশ কিছু অদ্ভুত নেশা। যে বয়সে ছেলেমেয়েরা বিভিন্ন খেলাধুলায় মেতে থাকে, সে বয়সে ছেলেটির ছিল অন্যরকম নেশা। ও যখন বুঝতে শেখে, তখন থেকেই কালী মন্দিরে যাওয়ার প্রতি তার একটা নেশা তৈরি হয়। এক দিন না খেয়ে থাকতে পারতো, কিন্তু কালী মাকে না দেখে থাকতে পারতো না। প্রতিদিন একবার করে শ্মশানে যেতেই হবে। কালী মাকে দুচোখ ভরে দেখতে পেলেই তবে শান্ত হত। প্রায় দুই কিলোমিটার পায়ে হেঁটে শ্মশানে ওর যেতেই হবে। মা-বাবা বারণ করলেও শুনতো না। নামও যেমন কালি প্রসাদ কাজও তেমনি কালী দর্শন। এযুগের সাধক কালি প্রসাদ।



               বর্তমানে কালি প্রসাদের বয়স প্রায় কুড়ি বছর। এখনো মা কালীর দর্শন প্রাত্যহিক করে যাচ্ছে ও। এই কুড়ি বছর শুধু মা কালী নয়, আরো অনেক নেশা ছিল ওর। ওর বয়স যখন বার বছর, তখন পুরনো সব ঠাকুর বিভিন্ন পাড়ায় ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করতো ও। এই নিয়ে মায়ের কাছে কখনো বাবার কাছে বকুনি খেতে হত। কিন্তু কারো বকুনিতে কোনো কাজ হয়নি। বাড়িতে ঠাকুর এনে ভর্তি করে দিয়েছিল।


              রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো কুকুর বিড়ালকে দেখে খুব কষ্ট পেতে ও। প্রায়ই বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে কুকুরগুলোকে ডেকে বিস্কুট খাওয়াতো। কুকুরের প্রতি মায়া পড়ে গিয়েছিল ওর। হঠাৎই কুকুর পোষার শখ জাগে মনে। বাবা-মাকে অনেক জ্বালাতন করেছিল কুকুর কিনে দেওয়ার জন্য। অবশেষে দুটি কুকুর বাবা কিনে দেয়। একটা ডোবারম্যান ও অন্যটি স্পিচ। তাদেরকে পেয়ে কালি প্রসাদ খুব আনন্দ পায়। তাদের দেখাশোনা সে নিজের হাতেই করত। তাদের স্নান করানো, খাওয়ানো, শোয়ার বিছানা করে দেওয়া, শরীর খারাপ হলে ডাক্তার ডেকে আনা। তাদের মুখে চুমু খেত ও। এই পাঁচ বছরে কুকুরগুলো কয়েকবার সাতটি- আটটি-দশটা করে বাচ্চা দিয়েছে। বাচ্চাগুলো ও বেচতে চাইনি কিন্তু বাবা বেঁচে দিয়েছেন। তাছাড়া পাড়ার দেশি কুকুর সব ওদের উঠানে থাকত। কমপক্ষে পনের- কুড়িটা।



           পশুপাখির প্রতি তাঁর অসীম ভালোবাসা ছিল। বড় হয়ে পশুদের ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখতো ও। তাই এখন চেষ্টাও করছে ডাক্তারি পড়ার জন্য। পাখিদেরও খুব পছন্দ করে কালি প্রসাদ। বাড়ির বাগানে বিভিন্ন পাখির আনাগোনা হলে ওর দেখতে খুব ভালো লাগে। অন্য সব প্রাণীদের প্রতিও ওর গভীর ভালোবাসা। গরু- ছাগল- ভেড়া দেখলে ও মাথায় হাত বোলায়, আদর করে। দেশি কুকুরদের শরীর খারাপ হলে ও ডাক্তার ডেকে তাদের চিকিৎসা করায়। নিরীহ প্রাণীদের আঘাত লাগলে খুব কষ্ট পায়, কান্না করে। একটা কুকুর মারা যাওয়ায় তিন দিন কিছুই খায় নি ও, এক সপ্তাহ শুধু কেঁদে কেঁদে বেরিয়েছিল।


           আর একটা নেশা ছিল কালি প্রসাদের। সেটা হলো ঠাকুর বানানোর নেশা। বাজার থেকে বিচালি, রং, চুল, সাজ-সরঞ্জাম সব কিনে এনে নিজের হাতে কালি ঠাকুর, লক্ষ্মী ঠাকুর, সরস্বতী ঠাকুর বানাত। খুব সুন্দর হাতের কাজ। সেই ঠাকুর বানিয়ে বাড়িতে ও নিজেই পুজো করতো। কালি প্রসাদ জাতিতে হিন্দু ব্রাহ্মণ ছিল। পুরো নাম কালিকা প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। প্রত্যেক বছর কালীপুজোর দিন নিষ্ঠার সঙ্গে কালী পুজো করতো ও। ওইটুকু ছেলের পুজো করা দেখে পাড়ার লোকেরা ধন্য ধন্য করত। পাড়ায় ও পাড়ার বাইরে ওকে ডেকে নিয়ে পুজো করাতো। ওর নিরীহ ভাব দেখে আমার মাঝে মাঝে মনে হতো -- ও বড় হয়ে সাধক বামাক্ষ্যাপা কিংবা রামপ্রসাদের মতো সাধক হবে নাতো।



         যখন কালি প্রসাদের দাদু-ঠাকুমা বেঁচে ছিলেন, তখন পারিবারিক অবস্থা খুব রমরমা ছিল। দাদু পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর ছিলেন। পুলিশের ঘরে এমন ছেলে ভাবাই যায় না। দাদু লক্ষী নারায়ন চট্টোপাধ্যায় নাতির নাম রেখেছিলেন কালিকা প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। আজ পাঁচ বছর হয়েছে দাদু-ঠাকুমা গত হয়েছেন। আজ পরিবার আগের মতো খুব একটা সচ্ছল নয়। চলছে এক প্রকার।


             এ জগতে বর্তমানে নত হওয়ার মানুষের বড়ই অভাব। আত্ম অহংকারে সবাই পরিপূর্ণ। সেখানে কালি প্রসাদের মতো বাধ্য ছেলে আমি দেখিনি। যে যা বলে মাথা নত করে সব করে দেয়। কখনো না বলে না। গুরুজনদের শ্রদ্ধা-ভক্তি করে খুব। 'যদি না হও নত, তবে হবেনা উন্নত।' এমন মাটির মানুষ আমি খুবই কম দেখেছি।


            গত দু'বছর ধরে ওর মধ্যে প্রকৃতিপ্রেম লক্ষ করেছি। প্রত্যেকদিন বিকেলবেলা একটা সাইকেল চালিয়ে  নতুন নতুন গ্রামে যায় ও। মাঠের ধান, বিভিন্ন গাছ, কুকুর, গরু, মোষ দেখতে ওর খুব ভালো লাগে। এ সকল দেখে ওর যে আনন্দ হয়, তা পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির আনন্দ থেকেও অনেক বেশি। তাঁর মতো হয়তো কালি প্রসাদের ধনসম্পত্তি নেই, কিন্তু আছে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসার হৃদয়--- যা আজকের মানুষের মধ্যে খুবই কম থাকে। সে সকলের থেকে আলাদা। একেবারে আলাদা।

( সমাপ্ত )

4 views0 comments
bottom of page