top of page
Search

বিরতি থেকে ফিরে ।। ভয়ের গল্প ।। চন্দন চট্টোপাধ্যায়


মধ্য রাতের অতিথি

চন্দন চট্টোপাধ্যায়





এটা সবাই মানবেন চেয়ে যে লেখালিখি করার জন্য একটু নিরিবিলি জায়গা প্রয়োজন, সঙ্গে একটু অবকাশ এবং একটু আরামও জরুরী, তাহলেই মনের ভিতরের কথাগুলো কলমের মাধ্যমে কাগজে ফুটে উঠবে, আর সেটা পড়ে পাঠককুল সমৃদ্ধি ও পরিতিপ্ত হবেন ।

গল্প পড়া, গান শোনা যে কোনো জায়গায় হতে পারে, যেমন অফিস যাবার সময় গাড়িতে বসে মোবাইল বা ট্যাবলেটে বা প্রিন্টেড বই হাতে নিয়ে পড়া যায় বা কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শোনা যায় । কিন্তু এই গান, গল্প, কবিতা লিখতে গেলে অনেক ধৈর্য, অধ্যবসায়, জ্ঞান এবং সর্বোপরি চিন্তা করার শক্তি ও পরিবেশ অবশ্যই প্রয়োজন । সকালে বাস ঠেঙ্গিয়ে অফিসে গিয়ে, সারাদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে, সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে এসে, স্ত্রীর সঙ্গে বাক্য যুদ্ধ ও শান্তি স্থাপনের মধ্যে দিয়ে যখন একটু নিরিবিলি ঘরের কোন পাওয়া যায়, তখন ঘুম ছাড়া মাথার মধ্যে আর কিছুই আসে না ।



এইজন্যে সমীর মাঝেমধ্যে শহর ছেড়ে তার গ্রামের বাড়ি উত্তরবঙ্গ সেবক রোডে কাছে চালসা গ্রামে চলে যায় । সমীর দেবনাথ বর্ধমান হাই স্কুলের ইকোনমিক্স এর টিচার, থাকে স্কুলের কাছে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে, গরমের ও পুজার ছুটিতে দেশের বাড়ি যায় । যদিও সে ইকোনোমিক্সের টিচার তাহলেও সাহিত্যের প্রতি তার বেশ আকর্ষণ আছে । ছোটগল্প, প্রবন্ধ এইসব লেখালেখি করে তার লেখা দু-একটা গল্প স্থানীয় পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে । সম্প্রতি হেমেন্দ্রকুমার রায়ের কিছু ভৌতিক গল্প পড়ে তার একটা ভূতের গল্প লেখার ইচ্ছা হয় । কোন বিষয়ে কিছু লিখতে হলে তার সম্বন্ধে একটু জ্ঞান থাকা প্রয়োজন, যেমন যদি কোন ব্যক্তি বিজ্ঞান বিষয়ক গল্প লিখতে চান তবে তাঁকে বিজ্ঞান সম্নধ্যে বিশদে জানতে হবে । যেমন তিনি যদি লেখেন জলের কেমিক্যাল কম্পাউন্ড এইচ টু এস ও ফোর (H2so4) তাহলে এসিডে জল নয়, জলে এসিড ঢালা হয়ে যাবে ।

তাহলে পাঠকদের মনে হতে পারে ভৌতিক গল্প লিখার জন্য কি ভূতের সাক্ষাৎ পাওয়া দরকার, তা যদি করতে হয় তাহলে তো মুশকিল । কারণ ভূতের কোথায়, কবে, কখন, দর্শন হবে তা তো তার জানা নেই, এমন কি তার পরিচিত কেউ জানে বলে মনে হয় না । আর অন্য লোককে যে জিজ্ঞেস করবে তাহলে তাকে পাগল বলে ভাববে । অতএব কল্পনার আশ্রয় তাকে নিতে হবে । এবার দুর্গা পূজার ছুটির সময় বাড়ি গিয়ে সে দু-তিনটে ভূতের গল্প লিখবে স্থির করলো । মহাষষ্ঠীর দিন স্কুল করে রাত্তিরে উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস ট্রেন ধরে পরের দিন সকালে বাড়ি পৌঁছায় । তার বাড়ি হল চালসা গ্রামে । এই গ্রামটা পরে মাল জংশন ও সেবক রোডের মধ্যে । ছবির মতো সুন্দর গ্রাম, একদিকে চা বাগান দূরদূরান্ত পর্যন্ত দেখা যায় সবুজ গাছ সার দিয়ে রয়েছে, অন্যদিকে তিস্তা নদী ।

তিস্তা নদীর ওপারে জঙ্গল, ওয়াইল্ডলাইফ ফরেস্ট । এখানে অনেক কোম্পানির চা বাগান আছে, তার মধ্যে চালসা টি গার্ডেন বেশ বড় । এই চা বাগানের ধারে একটা মডার্ন কলোনি আছে ওখানে তার বাড়ি । বাবা, মা মারা গেছেন, এখন আছে শুধু দূর সম্পর্কের কাকা বাড়িতে থাকে ও দেখাশোনা করে । সমীরের এখনো বিয়ে হয়নি, তার স্কুলের ইতিহাস শিক্ষিকাকে বেশ পছন্দ কিন্তু মুখ ফুটে সে কথা বলতে পারে নি আজ পর্যন্ত । এহেন ব্যক্তি কিভাবে ভৌতিক গল্প লিখবেন তা কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় ।

যাইহোক তাকে দেখেই তার কাকা বেশ খুশি, সমীরকে বলল “যা বাবু একটু বিশ্রাম করে চান করে নে আমি তোর জন্য ভালো তিস্তার তেলাপিয়া মাছ নিয়ে এসেছি বাজার থেকে , রান্না করবো “ । ট্রেনে সমীরের ভালো ঘুম হয় না তাই তেলাপিয়ার ঝাল দিয়ে গরম গরম ভাত খেয়ে সমীর একটা লম্বা দিবানিদ্রা দিল । ঘুম থেকে যখন উঠল তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেছে । তাদের পাড়ায় কোন দুর্গাপূজা হয় না, কিন্তু মাল বাজারে বড় পূজা হয় সেটা কালকে দেখতে যাবে ঠিক করল । পুজো আসলেই প্রকৃতিতে একটা আলাদা আমেজ আসে, সেটা সে ছোটবেলা থেকে দেখে আসছে । বর্ষা গড়িয়ে শরৎ আসে, তাই চারদিকে সবুজের সমারোহ, বনজঙ্গল এখন একটু বেশি ঘন ও সবুজ দেখায়, তিস্তা নদীতে এখন বেশ জল, সন্ধ্যের সময় একটা ফুলের গন্ধ বাতাসে ভাসে, অনেকটা এলাচের মত, সমীর এটার নাম দিয়েছে এলাচ ফুল এটা দুর্গাপুজোর সময় ফোটে । দূর থেকে ভেসে আসছে মাইকের গান, সবমিলিয়ে সত্যিই একটা উৎসবের আমেজ । সমীরের বাড়িটা কলোনির একদম শেষ প্রান্তে, এর পরেই চা বাগান শুরু, দোতলা বাড়ি, ওপর-নিচে দুটো করে ঘর । ওপরের ঘরে একটাতে সমীর থাকে খালি, অন্যটা খালি । নীচের ঘরে একটা রান্না ও খাওয়া-দাওয়া হয় অন্যটাতে কাকা থাকে ।



দুইদিন বেশ কাটলো ঠাকুর দেখা, খাওয়া-দাওয়া, ঘোরাঘুরি এতেই চলে গেল, ভৌতিক গল্প লেখার কথা সে প্রায় ভুলেই বসেছে । আজ দশমী, মায়ের বিসর্জনের দিন । সকাল থেকেই আকাশটা কি রকম মুখ ভার করে আছে, বোধ হয় মা চলে যাবে তাই ওর মন ভালো নেই । সন্ধ্যে হতে না হতেই কালো মেঘে চতুর্দিক ছেয়ে গেল এবং অল্প কিছুক্ষণ পরেই তুমুল বৃষ্টি ও তার সঙ্গে বজ্র পাত শুরু হলো । মনে হচ্ছে যেন মহাপ্রলয় আজকেই শুরু হবে । পাঁজিতে লেখা ছিল দেবী দুর্গার আগমন হাতিতে, গমন নৌকায় । কিন্তু মায়ের নৌকা চালাতে কতজন লাগবে তা বোঝা যাচ্ছে না । এই দুর্যোগে বাইরে কোথাও যাবার তো প্রশ্নই নেই, যদি কেউ ভুলে বাইরে গিয়ে থেকে থাকে তবে সেও ঘরের অভিমুখে তাড়াতাড়ি যাচ্ছে । একের দুর্যোগের রাত, তারপর ঘরে কোন কাজ নেই, তাই রাত ন'টার মধ্যে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ল । এত সকাল-সকাল তার অভ্যস নেই, তাই সে উসখুস করতে লাগলো, তার পর কখন ঘুমিয়ে পড়েছে তার খেয়াল নেই । রাত তখন কটা হবে কে জানে এমন সময় বাইরের দরজায় একটা আওয়াজ । সমীর ভাবল, কাকা এসেছে তাই জিজ্ঞাসা করল, “ কে ? “

বাইরে থেকে আওয়াজ আসলো, “মহাশয় আমি বিকাশ, দরজাটা একটু খুলবেন, খুব বিপদে পড়েছি তাই আশ্রয় চাইছি । চোর ডাকাত নই সে সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে পারেন । ”

আওয়াজ শুনে সমীর তাড়াতাড়ি নিচে দরজা খুলে দেখল এক বয়স্ক ব্যক্তি মাথায় ছাতা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কিন্তু বৃষ্টি তোরে তিনি পুরো ভিজে গেছে । বৃষ্টি তখনও পরছে তাই সমীর বলল, “ তাড়াতাড়ি ভেতরে আসুন ।“

ভদ্রলোক বাড়ির ভিতরে আসলে সমীর গেট বন্ধ করে তাকে উপরে নিয়ে আসলো । ভদ্রলোক একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “ মাফ করবেন, এত রাত্রে আপনাকে বিব্রত করার জন্য আমি সত্যিই খুব লজ্জিত, আসলে আমি যাচ্ছিলাম শিলিগুড়ি থেকে আলিপুরদুয়ার লোকাল ট্রেনে করে । চালসা স্টেশনে এসে বলল ট্রেন আর যাবে না, তিস্তা নদীর উপর রেললাইনে ফাটল দেখা দিয়েছে মেরামত করে তারপর যাবে । এখন ছুটির সময় তারপর এই দুর্যোগের রাত তাই কামরায় খুব কমই লোক ছিল, যারা ছিল তারাও আস্তে আস্তে সব নেবে চলে গেল । আমার বাড়ি আলিপুরদুয়ার কাছে, এখানে কোন আত্মীয়-পরিজন নেই, তাই আর কার কাছে যাবো আমিও ট্রেন থেকে নেবে হাঁটতে লাগলাম। এই চা বাগান ধরে হাঁটতে হাঁটতে আপনার বাড়িটা প্রথমে পরায় আমি আশ্রয় চাইলাম । “

সমীর বলল,” ঠিক আছে কোনো অসুবিধে নেই আমার পাশের ঘর খালি আছে আপনি শুতে পারবেন । আপনার খাওয়া দাওয়া হয়েছে ?”

ভদ্রলোক বলল, “ ব্যস্ত হবেন না আমি ট্রেনে খেয়েছি তাছাড়া আমার কাছে ফ্লাক্সে চা ও বিস্কুট আছে, আমার কোনো অসুবিধে হবে না “ ।

সমীর বলল, “ ঠিক আছে আপনি বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে নিন, আমি আমার একটা পাঞ্জাবী ও লুঙ্গি দিচ্ছি পরবেন”।

ভদ্রলোক ফ্রেশ হয়ে এসে পাঞ্জাবি লুঙ্গি পরে বিছানায় বসলো । সমীর জিজ্ঞাসা করল, “ আপনার নাম কি জানতে পারি “ ।



ভদ্রলোক, “ নিশ্চয়ই, আমার নাম বিকাশ রায়, আলিপুরদুয়ারে বাড়ি, ওখানে একটা দোকান আছে, শিলিগুড়ি পাইকারি বাজার থেকে মাল কিনে নিয়ে যে ওখানে বিক্রি করি “। কথা বলতে বলতেই ভদ্রলোক চায়ের ফ্লাক্সটি ব্যাগ থেকে বার করে সমীরকে এক কাপ চা অফার করলেন । তারপর দুইজনে দুকাপ চা নিয়ে বসল, মাঝেমধ্যে এ ওকে কিছু প্রশ্ন করে আবার ও একে কিছু প্রশ্ন করে, এইভাবে পাঁচ মিনিট যাওয়ার পর, কথায় কথায় সমীর ভৌতিক গল্প লেখা প্রসঙ্গ তুলল । বিকাশ বাবু বললেন,” সেটা তো ভালো কথা” ।

সমীর,” ভালো তো বটে কিন্তু ভৌতিক গল্প কিভাবে শুরু করব সেটাই বুঝতে পারছি না” ।

বিকাশ বাবু বললেন, “ আপনার হাতে যদি খানিকটা সময় থাকে তাহলে আমার সত্যিকারের ভূত দেখার অভিজ্ঞতার কথা বলতে পারি । সমীর চিয়ারে আরেকটু নড়েচড়ে বসলো, বাইরে তখনোও ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পরছে, জানলার ওপরের পাল্লাটা খোলা আছে, তাই একটা ঠান্ডা হওয়ার ঘরে আসছে, বাইরে একটা ঝি ঝি পোকা এবং কোলা ব্যাঙের ঐক্যতান শোনা যাচ্ছে, এটাই হল ভূতের গল্প শোনার আসল পরিবেশ । সমীর মোবাইলেতে দেখল রাত্রি একটা কুড়ি মিনিট অর্থাৎ দশমী শেষ, একাদশী শুরু ।

বিকাশ বাবু শুরু করলেন,” আমার বাবা মারা যান খুব ছোটবেলায় কাজেই সংসারের হাল আমাকে ছোটবেলা থেকেই ধরতে হয় । মায়ের কাছে শুনেছিলাম আমাদের আদি বাড়ি ছিল হাসিমারায়, কি একটা কারণে বাবা ওখানকার সমস্ত পাঠ চুকিয়ে আলিপুরদুয়ার চলে যান । ওখানে একটা দোকান করেন, নিচে দোকান উপরে আমাদের থাকার ঘর ছিল । সব ঠিকই চলছিল, তারপর হঠাৎ বাবার মৃত্যু হওয়ায় আমি দোকানের দায়িত্ব নিলাম । ধীরে ধীরে আমার বয়স ও বুদ্ধি দুটোই বারতে লাগলো । তারপর আমি ঠিক করলাম এখানকার পাইকারি বাজার থেকে কিনে খুচরো বিক্রি করলে লাভ খুবই কম হয়, কিন্তু এই মালটাই যদি শিলিগুড়ি পাইকারি বাজার থেকে কেনা যায় তাহলে কিন্তু লাভ অনেক বেশি হবে, কারণ শিলিগুড়ি পাইকারি বাজারে দাম এখানকার পাইকারি বাজারের দামের থেকে অনেক কম । তাই প্রতি মাসে একদিন করে শিলিগুরি বাজার থেকে মাল কিনে নিয়ে যেতাম এবং আমার দোকানে বিক্রি করতাম ।

আস্তে আস্তে এইভাবে ব্যবসাটাকে সাজাতে লাগলাম যেদিন আমি শিলিগুড়ি আসতাম সেদিন আমার মা অথবা স্ত্রী দোকানে বসত । সকালের গাড়িতে শিলিগুরি আসতাম আর মাল কিনে রাত্তিরে ফিরে যেতাম । যখন ব্যবসা আরো একটু বড় হল তখন আমি মাল ট্রান্সপোর্ট এর কাছে দিয়ে দিতাম, ওরা আলিপুরদুয়ারে আমাকে ডেলিভারি দিয়ে দিত ।

এইরকম একদিন শিলিগুড়ি থেকে সওদা করে শেষ ট্রেনে বাড়ি যাচ্ছি, ট্রেনটি যখন আলিপুরদুয়ারে পৌঁছাল তখন বাজে রাত্রি সাড়ে বারোটা । আপনি এদিককার লোক কাজেই জানবেন এদিকে সিঙ্গেল লাইন, একটা ট্রেন যদি উল্টোদিক থেকে এসে যায় তাহলে তাকে সাইড দেবার জন্য অন্য ট্রেনকে স্টেশনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয় । এইভাবে যেতে যেতেই আমার রাত্রি গভীর হয়ে যেত । এত রাত্তিরে রিস্কা থাকে না তাই আমি পায়ে হেঁটে যেতে লাগলাম । আমাদের বাড়ি স্টেশন থেকে নেবে প্রায় ১০-১২ মিনিটের হাঁটা পথ । গ্রামের মেঠো রাস্তা তারপর রাস্তায় আলো নেই । স্টেশন ছাড়িয়ে খানিকটা গেছি, এমন সময় মনে হলো কেউ আমার পিছু পিছু আসছে, এত রাত্তিরে কেউ কোথাও নেই তাই মনে একটু ভয় করতে লাগলো । মনে হল একটা ঘুঙরুর আওয়াজ আসছে । যেন সেটা আমার সঙ্গে সমান তালে পা ফেলে ফেলে যাচ্ছে । একবার আমি ইচ্ছে করে থেমে গেলাম দেখলাম আওয়াজটাও থেমে গেল । এবার আমার সত্যি ভয় হতে লাগল । খানিক বাদে দেখলাম চারদিকে একটা পচা গন্ধ ছাড়ছে মনে হল যেন মাংস পচে চারদিকে ছড়ানো রয়েছে । আমি যেখানটায় দাঁড়িয়ে ছিলাম তার হাত দশ বারো দূরে একটা শিমুল গাছ ছিল, ঠিক তার নীচে দপ করে একটা নীল রঙের আলো জ্বলে উঠেই নিভে গেল । তারপর একটা আপাদ-মস্তক সাদা কাপড় মুড়ি দেওয়া ছায়ামূর্তি লক্ষ্য করলাম । মূর্তিটা ছোট থেকে আস্তে আস্তে বড় হতে লাগলো, লম্বা হয়ে উপর দিকে উঠতে লাগল । সাদা কাপড়ের মধ্যে যেন দুটো জ্বলন্ত চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে, তারপর তার দুটো হাত আমার দিকে প্রসারিত করতে লাগলো । অন্ধকার হলেও একটু বুঝতে পারলাম যে এটা হাত নয় কঙ্কাল, এমতাবস্থায় রাম নাম নেওয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় আমার মাথায় এলো না । আমি পিছনের দিকে যে ফিরে আসব তার উপায় নেই কারণ সামনের দিক দিয়েই আমাকে বাড়ি যেতে হবে ।

আমার হাতে সবসময় একটা ছাতা থাকতো, সেইটাই খুলে আমি ঢাল হিসাবে ব্যবহার করব ঠিক করছিলাম এমন সময় একটা স্ত্রী কন্ঠ ভেসে আসল বিকু ভয় নেই আমি তোর কোন ক্ষতি করব না অপঘাতে মরেছি, গয়ায় পিণ্ডি দিয়ে আসবি আমার নামে , না হলে এ জ্বালা আমি সহ্য করতে পারছি না । আমার পাঁচ-পাঁচটা ছেলে কেউ আমায় ভাত দেয় না।

এতক্ষণে আমার সম্বিৎ ফিরে এল । আমাকে বিকু বলে ডাকত দেবুর মা । দেবু মানে দেবশংকর পন্ডিত, তারা পাঁচ ভাই রমাশংকর, উমাশঙ্কর, রবিশঙ্কর, উদয়শংকর । দেবু আমার সমবয়স্ক তার ভাইয়েরা সবাই বড় এবং প্রতিষ্ঠিত । আমাদের এলাকায় পন্ডিত পরিবারের খুব নাম, সবাই জানে, চেনে আমি অনেকবার তার বাড়িতে গেছি, তার মাকে আমি বড়মা বলে ডাকতাম । বড়মা আমাকে মাঝেমধ্যেই আচার, সিঙরা, নিমকি মোরব্বা ইত্যাদি দিতেন । স্কুলে পড়ার অনেকবার টিফিন করার জন্য আমাকে টাকা ও দিতেন । তিনি অসুস্থ ছিলেন সেটা শুনেছিলাম, কিন্তু অপঘাতে মারা গেছেন সেটা জানি না । জিজ্ঞাসা করলাম, “কবে মারা গেছ”?

উত্তর এলো কবে কি রে হতভাগা, এখনো আমার শরীরটা এই গাছের উপরে ঝুলছে । তুই এক কাজ কর, আমাদের বাড়িতে যা ওখানে গিয়ে সব কথা বল, তারপর ওরা যেন আমার শরীরটাকে নিচে নাবায় ।

এই কথা বলার পর সাদা কাপড় জড়ানো ছায়ামূর্তি গায়েব হয়ে গেল । আমি উপরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম একটা সাদা কাপড় জড়ানো কিছু তো ঝুলছে , কিন্তু কে বা কি তা পরিষ্কার হলো না । আমার ভয় পাচ্ছিল তাই আর নিজে রিস্ক নিলাম না । তাড়াতাড়ি পন্ডিত বাড়ির দিকে ছুটলাম । প্রথমে দেবুর কাছে গিয়ে সব কথা বললাম । সে বলল,” আজ থেকে একমাস মা আমার বাড়ি থেকে উমাদা বাড়িতে গিয়ে থাকবে বলেছিল” ।

আমি বললাম “চল তবে উমাদার বাড়িতে যাই” ।



উমাদা চোখ রগড়াতে রগড়াতে দরজা খুলে বলল “ এত রাতে কি ব্যাপার” ।

দেবু তাকে সব কথা খুলে বলল । তারপর একে একে পাঁচ ভাই এবং পাড়ার আরো কয়েকজন মিলে আলো, লাঠি, শাবল, দড়ি ইত্যাদি নিয়ে সেই শিমুল গাছের নিচে আসলো । সেই সাদা মূর্তির মুখের উপর আলো পড়তেই আমি চমকে উঠলাম । গাছের একটা ডালে দড়ি বাধা আর বড়মা গলায় দড়ির আর অপরপ্রান্তটা বাধা, তার দুই হাতের মুঠো খোলা এবং সোজা, চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে গেছে, জিব টা মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে প্রায় বুক পর্যন্ত এবং তার থেকে রক্তের ফোঁটা ঝরছে । এই রকম বীভৎস দৃশ্য আমি আগে কক্ষনো দেখিনি । আমরা বড়মার শেষ পরিণতি যে এত ভয়ঙ্কর হবে টা আমি স্বপনে ভাবতে পারিনি । দু তিনজন মিলে আস্তে আস্তে বডিটা কে নিচে নাবাল ।

তারপর পুলিশে খবর দিল, পুলিশ এসে বডিটা নিয়ে গেল পোস্টমর্টেম করার জন্য ।

এর একদিন পরে পাঁচ ছেলে মিলে মাকে দাহ করল । জীবিত অবস্থায় যাকে দু মুঠো ভাতের জন্য ছেলেদের দ্বারে যেতে হত, মৃত্যুর পর অবশ্য পাঁচ ছেলে মিলে মায়ের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান বেশ বড় করেছিল ।

এই পর্যন্ত বলে বিকাশবাবু থামলেন । সমীর বলল,” তাহলে এই ঘটনাটা কে লেখা যেতে পারে ? আপনি কি বলেন, হ্যাঁ আরেকটা কথা, আপনি আপনার বড়মার গয়ায় পিন্ডি দিয়েছিলেন” । ভদ্রলোক বললেন, “ হ্যাঁ, এই ঘটনার মাসখানেকের মধ্যেই আমি গয়ায় গিয়ে উনার পারোলৌকিক কর্ম সেরে আসি” ।

ঠিক আছে আপনি শুয়ে পড়ো কালকে আবার কথা হবে রাত অনেক হলো এই কথা বলে সমীর নিজের ঘরে চলে গেল । খাটে শুয়ে ভাবতে লাগল গল্পটা সত্যি কিনা জানিনা কিন্তু ভদ্রলোক বলেছেন বেশ গুছিয়ে এইটাকে যদি আরেকটু রং দিয়ে লেখা যায় তবে একটা সুন্দর ভৌতিক গল্প হতে পারে । এইসব কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল ঠিক নেই । তখন সকাল ন'টা বাজে, কাকা ডাকছে, “ সমীর বেলা হল চা খাবি তো “

সমীর ধরমর করে উঠে বসল একটু পরেই তার মনে হলো পাশের ঘরে বিকাশবাবু আছেন । সে কাকাকে বলল, “ কাকা তিন কাপ চা কর” ।

কাকা,” কেন তুই দু কাপ চা খাবি নাকি? “

সমীর’” আরে আমি নয় পাশের ঘরে এক ভদ্রলোক আছেন তার জন্য “

“ ভদ্রলোক, কোথা থেকে এল” কাকা একটু বিস্ময়ের সুরে জিজ্ঞাসা করল ।

সমীর একটু বিরক্ত হয়ে “ কাল রাতিরে এসেছেন সে অনেক কথা আমি তোমাকে পরে বলব ” ।

কাকা বলল,” পাশের ঘরে তো কেউ নেই তাহলে নিশ্চয়ই চোর এসেছিল, কিছু চুরি করে নিয়ে পালিয়েছে, বোধহয়” ।

কাকার কথা শুনে সমীর কিছুটা আশ্চর্য হল , তারপর দুজনে মিলে সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজে নিশ্চিন্ত হল যে কোন জিনিস চুরি যায়নি সব জিনিসই নিজ নিজ স্থানে বিদ্যমান । এমনকি সেই ভদ্রলোককে পরার জন্য যে লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি দিয়েছিল সেটা সমীর নিজেই পরে আছে ।

সমীর জিজ্ঞাসা করল,” কাকা তুমি যখন বাইরের দরজা খুলে ছিলে তখন তা ঠিকভাবে বন্ধ ছিল” ।

কাকা বলল,” হ্যাঁ সদর দরজা তো আমি তালা দিয়েছি রাত্রি এবং সকালে আমি খুলেছি । চাবি তো আমার ঘরে থাকে”

সমীর ভাবল তাহলে সে স্বপ্ন দেখেছে বোধহয় । তাই এটাকে আস্তে আস্তে মন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করতে লাগলো ।

ঘন্টাখানেক পরে বাজারের থলি হাতে নিয়ে, সমীর কাকাকে বলল,” কাকা আমি একটু বাজার থেকে ঘুরে আসি । স্টেশন রোডের বাজারে যাবো দেখি ওখানে তিস্তার মাছ পাওয়া যায় কিনা” ।

স্টেশন রোডের বাজারটা লাইনের ওপারে । তাইলে তাকে রেল লাইন পার করে যেতে হবে । লাইনের ধারে এসে সমীর দেখল এক জায়গায় কয়েকজন লোক জমায়েত হয়েছে । কাছে গিয়ে দেখল সাদা চাদর দিয়ে ঢাকা আছে একটা বডি । একজনকে জিজ্ঞাসা করায় সে বলল কালকে এক ব্যক্তি লাইন পার হওয়ার সময় বিপরীত দিক থেকে আসা এক্সপ্রেস গাড়ি এসে তাকে কেটে দেয় । এক ব্যক্তির মৃত দেহের মুখের ওপরের সাদা চাদরটা সরালো । মৃত ব্যক্তি চেহারা দেখে সমীরের আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হবার উপক্রম , তার মাথা ঘুরে গেল, বাজারের ব্যাগ হাত থেকে পরে গেল আরে এ তো বিকাশবাবু । এক রেলের অফিসার দাঁড়িয়ে ছিল, সে সমীরের অবস্থা দেখে জিজ্ঞাসা করল আপনি একে চেনেন । সমীর কালকের রাত্রের সব ঘটনা বলল । এই ব্যক্তির পকেটে একটা শিলিগুড়ি টু আলিপুরদুয়ারের টিকিট পাওয়া যায় । অফিসার আলিপুরদুয়ার জংশনে যোগাযোগ করল এবং এখান থেকে বডি পাঠাবার ব্যবস্থা করল ।

ঘরে এসে সমীর কাকাকে সব কথা খুলে বলল । কাকা বলল,”তুই ক’দিন থেকে যে ভূতের গল্প লিখতে চাইছিলি তাই স্বয়ং ভুতই তার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে গেছে”

বলাবাহুল্য এর পর সমীরের আর ভূতের গল্প লেখা হয়নি ।



bottom of page