top of page
Search

রামধনু ।। ২৫তম সংখ্যা ।। ধারাবাহিক ।। স্নেহা নাগ


ওজনের ওজন

স্নেহা নাগ



দেখতে দেখতে সময় পাখা মেলে উড়ে গেলো, সেই সাথে তিন্নি তার জীবনের একটা মাস ভালো মন্দ মিশ্র অভিজ্ঞতার সাথে কাটিয়ে দিলো প্রায় একমাস। এই অল্প সময়ের মধ্যেই তার মনের নরম মাটি অনেকটাই শক্ত হয়ে গেছে। নতুন বন্ধুত্বের সাথে সাথে বেশ কিছু মানুষের চোখের কাঁটাও সে হয়ে ইঠেছিলো। অনেকে যেমন তাকে ভালোবাসতো আবার কেউ কেউ তার পপুলারিটির জন্য তাকে বেশ বাঁকা নজরে দেখতো। নির্বাণ বাবু ,নন্দা দেবী আর বুবাই সকলেই তার অনুপস্থিতির মধ্যেও তার উপস্থিতি খুঁজে নিয়েছিলেন। উন্নত প্রযুক্তি বিদ্যার আশীর্বাদে রোজ সন্ধ্যে বেলায় মেয়েকে ভিডিও কলের মাধ্যমে কয়েক মুহূর্তের জন্য কাছে পেয়েই সন্তুষ্ট হতেন তারা আর তিন্নিও মানসিক ভাবে অনেকটাই স্থিত হতো তার বাড়ির লোকের সংস্পর্শে এসে। সেই সাথে রুমঝুমের সাথেও তার বন্ধুত্ব বেশ পাকা হয়ে উঠেছিলো। তবে সব কিছুর মধ্যে একজন ছিলো যার প্রভাব তিন্নির জীবনকে সব থেকে বেশি প্রভাবিত করে তুলেছিলো। তিনি হলেন প্রফেসর দাশগুপ্ত। হ্যাঁ, তবে এটা বলা ভুল হবে যে তিন্নিও আর সবার মতো ডক্টর দাসগুপ্তের প্রেমে হাবুডুবু খেতে শুরু করেছিল; কারন তিন্নির মনে সেই মানুষটি ঘর করে থাকলেও তা ওই প্রেম নামক বুদবুদের মতো ক্ষণস্থায়ী ছিলো না। তা ছিলো অত্যন্ত জোড়ালো এবং চিরস্থায়ী। শুধু সেই স্থানের নামকরন করাটাই বাকি ছিলো আর সেই নামকরণ নিয়েই মেতে উঠলো তার বন্ধুরা। কেউ কেউ তাকে খ্যাপাতে লাগলো তো আবার কেউ তার প্রতি ডক্টর দাসগুপ্তর ফেভার দেখবে হিংসায় জ্বলে পুড়ে ছাই হতে শুরু করল। তবে এই বিপরীত প্রতিক্রিয়া কিন্তু কোনোভাবেই প্রফেসর দাসগুপ্তর চরিত্রকে প্রভাবিত করতে পারেন নি। আসলে তিনি নিজের মাপ জানেন, তাই সকলের কু দৃষ্টি উপেক্ষা করে তিনি তার সাধ্য মতো তিন্নিকে ছোট খাটো নানান বিষয়ে গাইড করতে থাকলেন আর তার ত্বত্তাবধানে সমৃদ্ধ হতে লাগলো তিন্নি।


****


পর পর ক্লাস করে ক্লান্ত হয়ে গেছে তিন্নি। তাই নিজের মস্তিষ্ককে একটু বিশ্রাম দেওয়ার জন্য ক্যান্টিনের থেকে ভালো জায়গা আর কোথাও খুঁজে পেল না সে। তাই রুমঝুমকে নিয়ে সোজা চলে এলো ক্যান্টিনে। সেখানে সব থেকে কনের টেবিলটা যেন তার জন্যই ফাঁকা থাকে। ওটার ওপর শুধু তারই অধিকার। তাই নিজের জায়গা দখল করে সে মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলো। মিন্টু দা কে অলরেডি খাবারের অর্ডার দেওয়া হয়ে গেছে, এখন শুধু তা পরিবেশনের অপেক্ষা। তিন্নি বারবার কাউন্টারের দিকে দেখতে লাগলো আর খিদে সয় না, তখনই রূমঝুম তাকে বলল,


"এই একটা কথা বলবো?"


"হুম, বল।" উত্তর দিলো তিন্নি।


"বলছি যে প্রফেসর দাসগুপ্তকে তোর কেমন লাগে রে?"


প্রশ্ন শুনেই হকচকিয়ে উঠলো তিন্নি, হৃদস্পন্দন যেন ঝড়ের গতিতে ছুটতে লাগলো তার। তবু নিজেকে সংযত করে নিয়ে সে বলল,


"মনে! কি বলতে চাইছিস তুই?"


"না, মানে উনি যেভাবে তোকে হেল্প করে, তাই আর কি....!"


রুমঝুমের কথা শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো তিন্নি, বলল,


"তোর মাথার ঠিক আছে, কিসব যাতা বলছিস!"


রূমঝুম যদিও খারাপ কিছু ভেবে কথাটা বলেনি তবু তার কোনো যুক্তি দেওয়ার আগেই পিছন থেকে প্রিয়া বলল,


"ঠিক ই তো বলেছে ও। ব্যাপারটা আমাদের সবার চোখে পড়েছে।"


তিন্নি যেটার ভয় পাচ্ছিলো ঠিক তাই হলো। রুমঝুমের কথাটা ঠিক প্রিয়ার কানে গেছে আর সেই সুযোগেই সে আর তার সাঙ্গ পাঙ্গ দের নিয়ে এসে হাজির। যাকে থামানো দরকার নাহলে এই কথাটা রাষ্ট্র হয়ে যাবে। এতে শুধু যে তিন্নির সম্মানহানী হবে তা নয়, বরং ডক্টর দাশগুপ্তরও ক্ষতি। তাছাড়া এই সব আলোচনা ভুল করেও যদি তার কানে যায় তবে তিনি খুব রাগ করবেন । এইভাবে তিন্নি টেবিল থেকে উঠে দাঁড়ালো এবং বলল,


"দেখো প্রিয়া তোমার শত্রুতা আমার সাথে হতে পারে তবে তুমি এর মাঝে স্যারকে এনো না।"


উত্তরে ফিচেল হাসি হেসে সে বলল,


"কেনো, গায়ে লাগছে?"


"দেখো স্যার এসব শুনলে খুব রাগ করবেন।"


"বাবা, তুই তো দেখছিস স্যারের সব মুড সুইং খুব ভালো করে জানিস! তা তোর মতো মোটা বেঢপ মেয়ে ওই রকম একজন হ্যান্ডসাম মানুষকে কব্জা করলি কি করে?"


কথা টা শেষ হতে না হতেই প্রফেসর দাশগুপ্ত এসে হাজিরএবং প্রিয়ার কুরুচিকর মন্তব্যে তিন্নির উত্তর দেওয়ার আগেই তিনি বললেন,


"কব্জা করার জন্য রূপের প্রয়োজন হয় না মিস প্রিয়া। যোগ্যতা লাগে আর ও নিজের যোগ্যতায় আমি কেন আমাদের কলেজের অনেক প্রফেসরকেই কব্জা করে ফেলেছে। আসলে কি বলো তো, আমরা না এই ধরণের মেয়েদের মধ্যেই সমাজের ভবিষ্যত খুঁজে পাই, তোমাদের মতো শোপিস তো দোকানেও পাওয়া যায়; ঘর সাজানোর জন্য।"


প্রফেসর দাসগুপ্তর এই মন্তব্য প্রিয়ার মনের মধ্যে হিংসার লেলিহান শিখাকে যেনো আরো বাড়িয়ে দিল। তবু সে চুপ করে মাথা নামিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো। প্রিয়ার চোখে সেদিন ধ্বংসের আগুন দেখেছিলো তিন্নি। তাই তো সে চলে যেতেই সে বলল,


"আপনি এমন করে না বললেই ভালো হতো। জানি না এখন ও কি করবে!"


উত্তরে ডক্টর দাসগুপ্ত বললেন,


"এইসব মানুষকে কোনো দিন ভয় করো না। এরা শুধু নিজেরা জ্বলতে পারে, অন্যকে জ্বালানোর ক্ষমতা এদের নেই।"


"তবু স্যার। আজ প্রিয়া এমন বলল, কাল যদি সবাই বলে তখন?"


তিন্নির চোখে মুখে ফুটে ওঠে অহেতুক ভয়ের ছাপ দেখে প্রফেসর দাসগুপ্ত মৃদু হেসে বললেন,


"সে বললে বলবে, লোকের মুখ আছে ওরা বলবে আর আমাদের কান আছে, তাও দুটো। একটা দিয়ে শুনে অন্যটা দিয়ে বের করে দেব। তুমি এসব ভেবো না, শুধু মকনে দিয়ে পড়ে যাও। তোমায় অনেক বড় হতে হবে।"


"আর হ্যাঁ লঞ্চের পর আমার কেবিনে একটু এসো। তোমার এসাইনমেন্ট এর বিষয়ে একটু কথা আছে"


বলে তিনি চলে গেলেন। ইতিমধ্যে টেবিলে খাবার এসে হাজির। আর সময় নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না। তাই কোনদিকে না তাকিয়ে তিন্নি খেতে শুরু করল।


*****


তিন্নি সব রকম রাজনীতি থেকে নির্লিপ্ত থাকলেও রাজনীতি কিন্তু তাকে ছাড়েনি। যেখানে প্রফেসর দাসগুপ্তর উৎসাহে সে জোরকদমে পড়াশোনা শুরু করেছিল, অন্যদিকে সেই একই ব্যক্তি অপমানে ক্ষত বিক্ষত প্রিয়া মরিয়া হয়ে উঠেছিল তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য। সে নিজেকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছিলো না, বার বার তার মনে হচ্ছিলো,


"ওই মেয়েটার মধ্যে এমন কি আছে, যা আমার মধ্যে নেই। কলেজে প্রথম দিন থেকে প্রফেসর দাসগুপ্তকে আমার পছন্দ হয়েছিলো। কত চেষ্টা করলাম কিন্তু আমার দিকে ফিরেও তাকালো না। যে করেই হোক প্রফেসর দাসগুপ্তকে আমার চাই। উনি শুধু আমার তবেদারী করবেন আর কারোর না।"


মনের মধ্যে তার নানা রকম বিকৃত চিন্তার জন্ম নিতে শুরু করেছিল। আর সেই চিন্তার জোরেই সে নিজের মনে বলতে লাগলো,


"খুব বন্ধুত্ব হয়েছে না তোর তিন্নি রুমঝুমের সাথে। খুব উড়ছিস তোরা। এখন দেখ আমি কিভাবে একটা একটা করে তোর সবটা কেড়ে নি। আর প্রফেসর দাসগুপ্ত, আপনাকে যদি আমার কাছে না আনতে পারি, তবে আমার নাম প্রিয়া নয়।"


নিজের মনে একপ্রকার প্রতিজ্ঞা করে প্রিয়া কাকে যেন একটা ফোন করল এবং তারপর চোখ ভর্তি আগুন নিয়ে নিজের মনে হেসে উঠলো।


( ক্রমশ ... )

5 views0 comments
bottom of page