top of page
Search

১৮ই মে সংখ্যা ।। ধারাবাহিক উপন্যাস ।। সমীরণ সরকার


ree

যশোদা মিষ্টান্ন ভান্ডার

সমীরণ সরকার


( চতুর্থ পর্ব)


এরপর দীর্ঘকাল ধরে কাশেম খানের বংশধরেরাই রাজত্ব করে রাজপুরে।


[ দুই ]


পনের বছর আগে শ্রাবণ মাসের এক সোমবারে বাবা তারকনাথ এর মাথায় জল ঢালতে তারকেশ্বরে গেছিলেন পদ্মাবতী দেবী। বাবা তারকনাথের মাথায় জল ঢেলে পুজো সারার পরে , পূজারী ব্রাহ্মণদের উপযুক্ত দক্ষিণা দিয়ে সন্তুষ্ট করলেন পদ্মাবতী। মন্দির চত্বর থেকে বেরিয়ে রাস্তার দুই ধারে বসে থাকা দুঃস্থ মানুষদের প্রচুর দান ধ্যান করলেন তিনি।

এরপর তিনি বাবা ভোলানাথের নির্মাল্য নিজের ও স্বামীর মাথায় ঠেকিয়ে ভক্তিভরে প্রণাম জানালেন তারকেশ্বরের চরণে ।পূজার প্রসাদ স্বামীকে দেওয়ার পরে নিজের মুখে দিয়ে উপবাস ভাঙতে যাচ্ছেন পদ্মাবতী ,এমন সময় তার সামনে এসে দাঁড়ালো বছর পাঁচ-ছয়ের একটা ছেলে।



ছেলেটার খালি গা, পরনে হাফপ্যান্ট। দেখে বোঝা যায় গায়ের রং একসময় ফরসা ছিল,এখন পুড়ে তামাটে।তার উপরে আবার যত্নের অভাবে ধুলো মাটির স্তর জমেছে। ছেলেটার এক মাথা কোঁকড়া চুল যত্নের অভাবে রুক্ষ, জট পাকানো। গলায় যজ্ঞোপবীত উপযুক্ত পরিমার্জনার অভাবে শুভ্রতা হারিয়েছে

ছেলেটা হাত পেতে বলল, "আমাকে একটু প্রসাদ দেবে মা? কাল থেকে কিছু খাইনি গো।"

পদ্মাবতীর আর প্রসাদ খাওয়া হলো না। তিনি হাতের প্রসাদ টুকু তুলে দিলেন ছেলেটির হাতে।

ছেলেটা গোগ্রাসে খেয়ে ফেলল সবটুকু। তারপর ছেলেটা যেভাবে হাত চাটছিল, সেটা দেখেই পদ্মাবতী বুঝতে পারলেন যে, ছেলেটার অস্বাভাবিক খিদে পেয়েছে।

পদ্মাবতী ছেলেটা কে জিজ্ঞাসা করলেন, "তোর খুব খিদে পেয়েছে বাবা?"

ছেলেটা কোন উত্তর না দিয়ে পদ্মাবতী মুখের দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো।

পদ্মাবতীর স্বামী হরপ্রসাদ একটু ধমক দিয়ে বললেন,"কিরে, চুপ করে আছিস কেন? উত্তর দে।"

পদ্মাবতী স্বামীকে বললেন, ,"আহা, ওকে ওভাবে বলছ কেন?ওকে দেখে বুঝতে পারছ না যে ওর খুব খিদে পেয়েছে!"

ছেলেটা আবার পদ্মাবতীর মুখের দিকে তাকালো।



পদ্মাবতী ছেলেটাকে বললেন, "একটু দাঁড়া বাবা, আমি আগে একটু বাবার প্রসাদ মুখে দিয়ে নিই।"

পদ্মাবতী এবারে ভক্তিভরে বাবা তারকনাথ এর উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে প্রসাদ মুখে দিলেন।

পদ্মাবতীর স্বামী হরপ্রসাদ সরকার বললেন, "খামোখা বেচারীকে দাঁড় করিয়ে রাখলে কেন পদ্মা? দাও না ওকে দু-এক টাকা,ও কিছু কিনে খাক।"

পদ্মাবতী স্বামীর কথার উত্তর না দিয়ে ছেলেটাকে বললেন, " আমার সঙ্গে আয় বাবা।"

হরপ্রসাদ হাতের ঘড়ি দিকে তাকালেন। বেলা প্রায় সাড়ে বারোটা। তাড়াতাড়ি খাওয়া-দাওয়া সেরে 1:45 এর ট্রেন ধরতে পারলে কামারকুন্ডু স্টেশন এ নেমে ট্রেন বদল করে বর্ধমানে ফেরার ট্রেনটা ধরতে পারবেন। ওটা মিস হয়ে গেলে বর্ধমানে রাত কাটাতে হবে, রাজপুরে আজকে ফেরা হবেনা।

তাতে অবশ্য সমস্যা নেই। বর্ধমানে মাসতুতো বোন সুনন্দার বাড়ি। ওতো কতদিন থেকে বারবার করে ওর বাড়িতে বেড়াতে যেতে বলছে। কিন্তু সময়াভাবে যাওয়া হয়ে ওঠেনি।

আজকে সমস্যায় পড়ে রাজপুরে যাওয়া না হলে সুনন্দার বাড়িতে রাতটা কাটাতে হবে। খুব খুশি হবে ও।

‌ছোটবেলায় মেজমাসী মেয়ে সুনন্দা কে নিয়ে প্রায়ই বেড়াতে আসত রাজপুরে। হরপ্রসাদ এর সঙ্গে খুব ভাব ছিল। বলতে গেলে এক রকম ন্যাওটা ছিলো ওর। ওর বিয়েতেও গেছিল হরপ্রসাদ।

বিয়ে, সুনন্দার বৌভাতের দিনে কনেযাত্রী যাওয়া ,অষ্টমঙ্গলার দিনে আনন্দ করা কিছুই বাদ যায়নি। সুনন্দার শ্বশুরমশাই ব্যবসাদার। মস্ত বড় কাপড়ের দোকান ওদের।



সুনন্দার শ্বশুর,শাশুড়ী খুব ভালো মানুষ। যথেষ্ট যত্নআত্তি করেছিল কনেযাত্রীদের। হরপ্রসাদ কে বারবার করে বলেছিলেন,আবার বোনের শ্বশুরবাড়ীতে বেড়াতে যেতে। একবার গেছিল হরপ্রসাদ। তারপর আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি।আজ সুযোগ পেলে অনেকদিন পরে আবার দেখা হবে সবার সঙ্গে।

পদ্মাবতী ছেলেটিকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটছেন। পিছনে হরপ্রসাদ সরকার। হাঁটতে হাঁটতে পদ্মাবতী একটা পরিচিত আদর্শ হিন্দু হোটেলের সামনে এসে দাঁড়ালেন। হোটেলের মালিক

ঘনশ্যাম চক্রবর্তী তাঁর পূর্ব পরিচিত।

তিনি পদ্মাবতী দেবীকে বললেন," ওকে আপনি কোথায় পেলেন মা?"

------- আপনি চেনেন ওকে! ও কে?

------ বছরখানেক আগে ওই ছেলেটিকে নিয়ে ওর মা এসেছিল এখানে পুজো দিতে। পূজো সেরে মন্দির থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেই হঠাৎ ওই মহিলা অসুস্থ বোধ করায় বাইরে এসে বসে পড়েন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বুক চেপে শুয়ে পড়েন। আর ওঠেননি উনি।

----তারপর?

----- আমরা ডাক্তার ডেকেছিলাম, কিন্তু ওই মহিলাকে বাঁচাতে পারিনি। ডাক্তার বলেছিলেন, হার্ট অ্যাটাক । তা সেই থেকে মাধব এখানে আছে।

------কে মাধব?

---- যে ছেলেটিকে আপনি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন মা,ওর নাম মাধব। দেখুন ওর ডান হাত উল্কি দিয়ে লেখা আছে ওর নাম।



------ ওকে ওর বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন নি?

------ ও তো ঠিক করে ওর ঠিকানাই বলতে পারেনি। তবুও চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু কোনো খোঁজ পাইনি। সেই থেকে ও এখানে আছে।

---- ও থাকে কোথায়?

------- কোন ঠিকানা নেই মা। যখন যেখানে ইচ্ছা হয়, সেখানেই থাকে ও।

----মানে?

------- ও মন্দিরের চাতালেও থাকে আবার কখনো ইচ্ছে হলে কোন দোকানেও থাকে। যে যা খেতে দেয় তাই খায় ও।

----- আহারে!

চোখের জল মুছেছিলেন পদ্মাবতী। তারপর ছেলেটা কে কাছে টেনে নিয়ে বলেছিলেন," আমি যদি ওকে সঙ্গে করে আমার বাড়িতে নিয়ে যাই কেউ আপত্তি করবে নাতো?

------ না না মা, কেউ আপত্তি করবে না। ও তো আপনাদের স্বজাতি ,ব্রাহ্মণের ছেলে। আপনাদের সঙ্গে গেলে ওর তো একটা হিল্লে হবে। আপনি ওকে নিয়ে যান মা।



হরপ্রসাদ বললেন, "কিন্তু পদ্মা,ওর বাড়ির লোক যদি খোঁজ করে ওর?"

------ না বাবু ,গত এক বছরে কেউ খোঁজ করেনি ওর। আমরা ওর ছবি ছাপিয়ে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম। স্থানীয় থানাতেও জানিয়েছিলাম। তারাও অনেক চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।

আর সত্যিই যদি কেউ ওর খোঁজ করে, আপনাদের রাজপুরের ঠিকানা দিয়ে দেব। আপনি নিশ্চিন্তে নিয়ে যান ওকে।



(,চলবে)

 
 
 

Comments


Subscribe Form

Thanks for submitting!

©2021 by Agantuk Potrika.

bottom of page